যে পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একক ভর্তি পরীক্ষার কথা ভাবা হচ্ছে

নতুন নিয়মে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ) নামে পৃথক একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে
ছবি: প্রথম আলো

দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোন পদ্ধতিতে ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন রকমের চিন্তাভাবনা করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ (ইউজিসি) এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ক্ষেত্রে ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতের উচ্চশিক্ষায় ভর্তিপদ্ধতির আলোকে বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য একটি পদ্ধতি কীভাবে নির্ধারণ করা যায়, তা নিয়েই এ চিন্তাভাবনা চলছে।

এর আগে ৩ এপ্রিল ইউজিসিতে অনুষ্ঠিত এক সভায় আগামী বছর (২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে) থেকে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। নতুন এ নিয়মে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ) নামে পৃথক একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। তবে চলতি বছর বিদ্যমান নিয়মেই ভর্তি পরীক্ষা হবে।

নতুন এ নিয়মে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ) নামে পৃথক একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে।

ওই দিনের সভায় কোন পদ্ধতিতে এ পরীক্ষা হবে, সে বিষয়ে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও এখনো সেই কমিটি গঠন করতে পারেনি ইউজিসি। তবে পদ্ধতি নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে।

একক ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি কেমন হতে পারে, তা নিয়ে কথা হয় ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীরের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক চিন্তাটি হলো প্রথমে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে এনটিএ গঠন করা। ভারতেও এনটিএ আছে। এনটিএ করবে সরকার। এটি হওয়ার পর উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপরই এনটিএর অধীন ভর্তির জন্য পরীক্ষা হবে। এ পরীক্ষা দুই ধাপে হতে পারে। প্রথম ধাপে সবার জন্য বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানের মতো অভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা হবে। দ্বিতীয় ধাপে যাঁর যাঁর বিভাগভিত্তিক (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) বিষয়ের ওপর পরীক্ষা হবে। দুই ধাপের এ পরীক্ষা একসঙ্গেও হতে পারে, আবার আলাদাভাবেও হতে পারে। একসঙ্গে হলে অভিন্ন বিষয়ের পরপর বিভাগ অনুযায়ী প্রশ্নপত্র দেওয়া হবে। তবে এগুলো প্রাথমিক সিদ্ধান্ত। কত ঘণ্টায়, কত নম্বরে পরীক্ষা হবে, সেগুলো পরে ঠিক হবে।

ভারতেও এনটিএ আছে। এনটিএ করবে সরকার। এটি হওয়ার পর এইচএসসির পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপরই এনটিএর অধীনে পরীক্ষা হবে। পরীক্ষা হতে পারে দুই ধাপে। প্রথম ধাপে সবার জন্য বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানের মতো অভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা হবে। দ্বিতীয় ধাপে যার যার বিভাগভিত্তিক (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) বিষয়ের ওপর পরীক্ষা হবে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর,ইউজিসির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তখন নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনলাইনে বিজ্ঞপ্তি দেবে। কোনো বিষয়ে কী যোগ্যতা লাগবে, তা–ও বলে দেবে। সেখানে এসএসসি ও এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার ফলাফল থেকে কত নম্বর নেবে এবং এনটিএ পরীক্ষা থেকে কত নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি করা হবে, তা জানিয়ে দেওয়া হবে। এরপর ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা তাঁদের ফলাফল অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য আবেদন করবেন। এ জন্য তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে না। কারণ, পুরো কাজটি হবে অনলাইনে।

অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি নির্ধারিত সময় দিয়ে ভর্তির কাজটি শেষ করা হবে। এ ক্ষেত্রে একজন ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন, সেটির নিশ্চায়ন দেবেন এবং কেবল সেটির জন্যই ভর্তি ফি জমা দেবেন। তবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম একটি ‘প্রসেস ফি’ দিতে হবে। এভাবে ভর্তির কাজ শেষে সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ক্লাস কাছাকাছি সময়ে শুরু করা হবে।

এ বছর বিদ্যমান নিয়মে ভর্তি পরীক্ষা হলেও আগামী বছর থেকে দেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে

মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও এনটিএর অধীন করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানালেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক আলমগীর। আর এনটিএর অধীন বছরে দুবারও পরীক্ষা হতে পারে বলে জানালেন তিনি।

‘ওয়েটেজ’ পদ্ধতিতে মেধাতালিকা

ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, ৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভায় একক ভর্তি পরীক্ষার জন্য একটি কাঠামো, জাতীয় পর্যায়ে একটি নীতিমালা তৈরি ও পরীক্ষার মাধ্যমে একটি স্কোর দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ওই সভায় কমিশনের ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম একক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন।

জানা গেছে, অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগমের ওই ধারণাপত্রে বলা হয়, বর্তমানে প্রকৌশল ও বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পদার্থ, রসায়ন, গণিত, ইংরেজি ও ড্রয়িংয়ের ওপর পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পদার্থ, রসায়ন, গণিত, বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানের ওপর পরীক্ষা হচ্ছে। অবশ্য আইবিএর ভর্তি পরীক্ষায় কিছুটা ভিন্নতা আছে। সেখানে বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ ছাড়া মেডিকেল ও কৃষিশিক্ষায় ভর্তির জন্য পদার্থ, রসায়ন, গণিত, জীববিজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান ও ইংরেজি বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়।

দিল আফরোজা বেগম তাঁর ধারণাপত্রে বলেন, ওই তিন ধারাকে সংক্ষেপ করে নয়টি বিষয়ে (মডিউল) পরীক্ষা নিলে ‘ওয়েটেজ’ পদ্ধতিতে প্রকৌশল, বিজ্ঞান, কলা ও মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও কৃষিশিক্ষার জন্য মেধাতালিকা করা সম্ভব।

ওয়েটেজ পদ্ধতিতে কীভাবে হতে পারে, তারও একটি উদাহরণ দিলেন দিল আফরোজা বেগম। ধরা যাক, স্থাপত্য বিভাগ ঠিক করল—তাদের এখানে যাঁরা ভর্তি হবেন, তাঁদের ড্রয়িংয়ে অবশ্যই ৭০ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। যাঁরা আর্কিটেকচারে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন, ভর্তি পরীক্ষার পর দেখা গেল, তাঁদের মধ্যে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী ৭০ শতাংশ পেয়েছেন। এখন এই পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর মেধাতালিকা কীভাবে হবে? তখন ড্রয়িংয়ের প্রাপ্ত নম্বরের ওয়েটেজ হবে ৭০ শতাংশ, পদার্থে ১০ শতাংশ ও গণিতে ২০ শতাংশ।

দিল আফরোজা বেগমের ধারণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, এনটিএ প্রতিষ্ঠা করে কম্পিউটারভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা করা গেলে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র পরিবহনেরও প্রয়োজন হবে না। পরীক্ষার আগে লগ ইন করলে বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্র (এমসিকিউ) ও গণিত–বিষয়ক প্রশ্ন কম্পিউটারে আসবে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই ফলাফল কম্পিউটারে দেখতে পারবেন। এ পদ্ধতিতে ওএমআর প্রসেস করার প্রয়োজন থাকবে না। তখন ভর্তি পরীক্ষার এক মাসের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সফটওয়্যারসহ কম্পিউটার সরবরাহ করতে হবে। অবশ্য কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষার জন্য কম্পিউটার ছাড়াও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

তাই কম্পিউটারভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা এখনই সম্ভব কি না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে।

বর্তমানে পরীক্ষা হয় যেভাবে

বর্তমানে দেশে ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ১১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আলাদাভাবে ভর্তি করা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা ভর্তি পরীক্ষা হয়। তবে ২২টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুচ্ছভুক্ত হয়ে, তিনটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট, কুয়েট ও রুয়েট) আরেকটি গুচ্ছে এবং কৃষি ও কৃষিশিক্ষাপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় অপর একটি গুচ্ছভুক্ত হয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, আন্তরিকতার অভাব, ‘ইচ্ছাকৃত সংকট’ তৈরি করে রাখাসহ কয়েকটি কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি সুস্থির ভর্তিব্যবস্থা চালু করা যাচ্ছে না। এ জন্য ভর্তি নিয়ে এখনো একধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দীর্ঘ বছরের চেষ্টায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে দেশের ৩০টির বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছভুক্ত হয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ায় বড় অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু একই গুচ্ছে থাকা ২২টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে এখনো সংকটগুলো কাটেনি। ‘জটিলতার’ কারণে এখানে ভর্তির কাজ শেষ করতে দীর্ঘ সময় লাগছে। ফলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতিও রয়ে গেছে। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে এখন আগামী বছর থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলো।