শিক্ষা খাতের বাজেট নিয়ে তাঁরা তিনজন যা বললেন

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়লেও শতকরা হারে তা কিছুটা কমেছে। জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ মুস্তফা কামাল আগামী অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন। ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার এই বাজেটে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এবারের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী, জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান এবং শিক্ষার বাজেট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ। তাঁদের প্রতিক্রিয়া নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মোশতাক আহমেদ

রাশেদা কে চৌধূরী
রাশেদা কে চৌধূরী

পুনর্বিবেচনা করা দরকার: রাশেদা কে চৌধূরী

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, একটুখানি ভালো লাগার জায়গা হলো, ‘মিড ডে মিল’ (স্কুল ফিডিং কর্মসূচি) চালু করা হচ্ছে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার যে মূল জায়গাগুলো; মান উন্নয়ন, বিশেষ করে যে অগ্রসরমুখী নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে, সেটি বাস্তবায়নে কোনো দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়নি। শিক্ষাবিদেরা তো বলে আসছেনই, সরকারের নিজের করা জাতীয় শিক্ষানীতিতেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে শুভংকরের ফাঁকির মধ্যে পড়ে গেলাম। সেটি হলো ২০২১-২২ অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশের ওপরে ছিল। ২০২২-২৩ সালে ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়। কিন্তু এবার এটি ১ দশমিক ৭৬ শতাংশে নেমে গেল। তাহলে টাকার অঙ্কে বাড়লেও কী করে বলতে পারি শিক্ষায় বরাদ্দের ব্যাপারে সরকারের অঙ্গীকারের প্রতিফলন ঘটেছে? বলার সুযোগ নেই। শিক্ষানীতি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, রূপকল্প ২০৪১—সরকারের নিজের। কিন্তু শিক্ষার বরাদ্দে সেগুলোর প্রতিফলন দেখা যায়নি। তৃতীয়ত হলো, প্রতিবারের মতো এবারও শিক্ষার বাজেটের সঙ্গে কোনো না কোনো মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আমরা বরাবর দাবি করে এসেছি, প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা খাত হিসেবে বিবেচনা করে যেন বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। তার সঙ্গে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সম্পর্ক আছে। সম্পর্ক তো আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও, সম্পর্ক তো আছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও। কিন্তু শিক্ষা খাতকে আলাদাভাবে বিবেচনা করে বরাদ্দ করা উচিত। কিন্তু সেটি হয়নি। তাই পরামর্শ হলো, অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় যা বলেছেন, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে স্মার্ট নাগরিক, দক্ষ জনগোষ্ঠী এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রসর জনগোষ্ঠী তৈরি করা। আর সেটির জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগের বিকল্প নেই, সেটি নীতিনির্ধারকেরা দেখবেন এবং সেভাবে বরাদ্দের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন, ভাববেন।

অধ্যাপক এম তারিক আহসান

শিক্ষার রূপান্তরের কাজ কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জে পড়বে: এম তারিক আহসান

জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়লেও মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় এই বরাদ্দ আশাব্যঞ্জক নয়। আবার শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি খাতের বাজেট একসঙ্গে হিসেবে করে দেখানো হয়েছে। শিক্ষা খাতে এখন রূপান্তর হচ্ছে, এর ফলে যে পরিবর্তন আশা করি, তার জন্য বরাদ্দ আশাব্যঞ্জক নয়। আরেকটি বিষয় হলো, শিক্ষার উন্নয়নের জন্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ, সেই গবেষণা বরাদ্দও আশানুরূপ কি না তা স্পষ্ট নয়।

গতানুগতিক এই বাজেট নতুন শিক্ষাক্রম ও শিক্ষার রূপান্তরের কাজ কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জে পড়বে। তবে গতবার শিক্ষার রূপান্তরকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিভিন্ন খাত থেকে অর্থ সংগ্রহ করে কাজগুলো এগোনোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এটি অস্থায়ী ব্যবস্থা, এর একটি স্থায়ী ব্যবস্থা দরকার, যাতে দীর্ঘ মেয়াদে কীভাবে লক্ষ্যগুলো অর্জন করব তার দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। সেটার সঙ্গে মিল রেখে বাজেট বরাদ্দের সম্পর্ক থাকা উচিত।

এম আবু ইউসুফ : অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কলমের ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করা উচিত: এম আবু ইউসুফ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ বলেন, আমার কাছে শিক্ষার বাজেট গতানুগতিক মনে হয়েছে। যেহেতু মোট বাজেটের আকার বেড়েছে, সেহেতু শিক্ষা খাতে বরাদ্দও টাকার অঙ্কে বেড়েছে। শিক্ষা ও প্রযুক্তি শিক্ষার বাজেট একসঙ্গে দেখানো হয়েছে। তাতেও এটি এবার হয়েছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশের মতো। যেটি গত বাজেটে (চলতি অর্থবছরের) ১ শতাংশের মতো বেশি ছিল। আসলে শিক্ষার বাজেটটি আলাদাভাবে দেওয়া উচিত। যদি প্রযুক্তি বাদে শিক্ষার বাজেট দেখি, সেটি ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশের মতো। সব মিলিয়ে শিক্ষার বাজেটটি গতানুগতিক মনে হয়েছে। গবেষণার ক্ষেত্রে যেমন বরাদ্দ আশা করি, তা দেখিনি। আর কলমের ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রত্যাহার করা উচিত। কারণ, যখন বলছি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছি, সেখানে এটি সাংঘর্ষিক হয়।