লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
গেস্টরুম ও গণরুম সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে।
একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটির বেশি পদে থাকতে পারবেন না।
মেধা ও আর্থসামাজিক প্রয়োজন বিবেচনায় প্রথম বর্ষ থেকেই আবাসিক হলে সিট বরাদ্দ দিতে হবে।
কমাতে হবে উপাচার্যের ক্ষমতা।
একজন শিক্ষার্থী অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ভর্তির কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁকে হতাশা ঘিরে ধরে। আবাসিক হলে আসনের জন্য তাঁকে মেরুদণ্ড বিকিয়ে দিতে হয়। এভাবে একে একে স্বপ্নগুলো মরতে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিস্থিতি।
এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভয়ের সংস্কৃতি ভেঙে একটি বৈষম্যহীন ও নিপীড়নমুক্ত মানবিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে হবে। গেস্টরুম সংস্কৃতি (আদবকায়দা শেখানোর নামে নির্যাতন) ও গণরুম সংস্কৃতি (এক কক্ষে গাদাগাদি করে থাকা) বন্ধ করতে হবে। কমাতে হবে উপাচার্যের ক্ষমতা। শিক্ষা ও গবেষণার সব ক্ষেত্রেই একাডেমিক ও চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বন্ধ করতে হবে লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি। তবে ছাত্র সংসদগুলো সচল করতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত চরিত্রটি বদলানোর জন্য রাষ্ট্রের সংস্কারও জরুরি।
আজ সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এ কথা উঠে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসমাজ নামে একটি প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে আয়োজিত এই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ থেকে শুরু করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা অংশ নেন।
মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন প্রস্তাব–সংবলিত মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষক। তাঁরা হলেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের জোবাইদা নাসরিন, জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের আবদুল্লাহ-আল মামুন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের খোরশেদ আলম এবং থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজের শাহমান মৈশান।
মূল প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কতগুলো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যমান লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষক ও পেশিশক্তিনির্ভর ছাত্ররাজনীতি এবং সাম্প্রদায়িক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা; বিতর্ক, সমালোচনা, প্রশ্ন যদি যৌক্তিক কারণে সরকার, রাষ্ট্র বা কোনো প্রতিষ্ঠিত ভাবাদর্শকে সমালোচনা করে, তবে সেই গঠনমূলক জ্ঞানচর্চাকে রাষ্ট্রের সুরক্ষা দেওয়া; শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিপীড়ন ও হয়রানি বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিপীড়ন-বৈষম্যবিরোধী সেল’ গঠন; আচরণবিধিমালা প্রণয়ন; বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বিশ্ব স্বীকৃতি মানসম্মত অনুপাত ১: ২০ হলেও বিদ্যমান বাস্তবতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তা ১: ৪০–এর বেশি না হওয়ার ব্যবস্থা করা; ‘টিচিং ইউনিভার্সিটির (শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়) পরিবর্তে টিচিং অ্যান্ড রিসার্চ (শিক্ষা ও গবেষণা)’, এই মিশ্র বৈশিষ্ট্যের বিশ্ববিদ্যালয় করা; মেধা ও আর্থসামাজিক প্রয়োজন বিবেচনা করে প্রথম বর্ষ থেকেই আবাসিক হলে আসন বরাদ্দ; পিএইচডি প্রোগ্রামে পরিবর্তন আনা; শিক্ষকদের পদোন্নতিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থা যুক্ত করা এবং ঢাকার বড় সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে ছেড়ে দেওয়া।
জুলাই অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাক্স্বাধীনতা উদ্যাপনের এই ঐতিহাসিক কালপর্ব বহুমুখী সুযোগ এনে দিয়েছে। চলুন, এই সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে নিজেদের পরিবেশ-প্রতিবেশ-প্রতিষ্ঠানকে অধিকতর গণতান্ত্রিক, গণবান্ধব ও কার্যকর করে করে তুলি।জোবাইদা নাসরিন, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক খোরশেদ আলম প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বলেন, ‘গেস্টরুম ও গণরুম কালচার জাদুঘরে পাঠাতে চাই।’
শিক্ষকদের প্রস্তাবের মধ্যে আরও রয়েছে একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটির বেশি পদে (সিন্ডিকেট, সিনেট, ডিন, প্রভোস্ট ইত্যাদি) থাকতে পারবেন না, শিক্ষক সমিতির পদে থাকা কোনো শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় বা রাষ্ট্রের কোনো প্রশাসনিক পদ গ্রহণ করতে পারবেন না, নতুন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা ও শিক্ষকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপনকারী শিক্ষকদের একজন আবদুল্লাহ-আল মামুন বলেন, শিক্ষা খাতে বাজেট না বাড়ালে বৈষম্য দূর হবে না।
মূল প্রবন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করতে উপাচার্যের কর্মপরিধি কমিয়ে তা অন্যদের মধ্যে বণ্টন করা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চা ও দীর্ঘসূত্রতা থেকে মুক্ত করা; ছুটি, সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট ইত্যাদি কাজ সহজ ও স্বচ্ছ করার প্রস্তাব করা হয়।
এ বিষয়ে শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বলেন, ‘আমরা সবকিছুতে উপাচার্যের হস্তক্ষেপ চাচ্ছি না। জুলাই অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাক্স্বাধীনতা উদ্যাপনের এই ঐতিহাসিক কালপর্ব বহুমুখী সুযোগ এনে দিয়েছে। চলুন, এই সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে নিজেদের পরিবেশ-প্রতিবেশ-প্রতিষ্ঠানকে অধিকতর গণতান্ত্রিক, গণবান্ধব ও কার্যকর করে করে তুলি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীরা নিপীড়িত হয়েছেন, গেস্টরুম ও গণরুমকেন্দ্রিক ভয়ংকর নির্যাতনের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বলে উল্লেখ করেন থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজের শাহমান মৈশান। তিনি বলেন, পদ্ধতিগত ভয়ের সংস্কৃতি ভেঙে একটি বৈষম্যহীন-নিপীড়নমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে হবে। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার মানের অবনতি ঘটেছে। নিয়োগে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রাধান্য পেয়েছে। প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে।
মূল প্রবন্ধে তুলে ধরা প্রস্তাবগুলোর কিছু মতামত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ‘আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্বজনতার বিশ্ববিদ্যালয় করতে চাই।’ তিনি জানান, চলতি মাসের শেষের দিকে বা তার একটু আগে সিন্ডিকেটের অনুমোদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে চান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী নিজের ছাত্র ও শিক্ষকতায় প্রবেশের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘যে বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে চেয়েছি, তা হয়নি। এটা আমার দুঃখ।’
রাজনীতি করা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু হলগুলোতে সেই দখলদারত্বের রাজনীতি থাকবে না। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি ক্যাম্পাসে থাকবে না।আবদুল কাদের, সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন, চিন্তাকে চিন্তা দিয়ে, বইকে বই দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। বইকে বুলেট নয়, চিন্তাকে চাপাতি দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না।
বিশাল জায়গাজুড়ে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাংলো ভেঙে দেওয়া বা জাদুঘর করার দাবি জানান অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
মতবিনিময় সভায় অংশ নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী উমামা ফাতেমা। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবান্ধব একটি একাডেমিক বিশ্ববিদ্যালয় রূপে পরিণত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজ কাজ করছে। এ উদ্যোগে আরও বেশি ছাত্র-শিক্ষককে যুক্ত করা জরুরি। সবাইকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জায়গা তৈরি করা জরুরি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আবদুল কাদেরও সভায় বক্তব্য দেন। আগামী দিনে কাজের জন্য অতীতের কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার সামনে একঝাঁক তরুণ বসে আছেন, যাঁরা অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বিনিময়ে কী পেয়েছি, শুধু হতাশা আর হতাশা।’ তিনি আরও বলেন, একটি অজপাড়া গাঁ থেকে আলাভোলা একজন মেধাবী শিক্ষার্থী যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, তাঁরা দুই থেকে তিন মাস পর, যাঁরা আবাসিক হলে উঠেন তাঁদের মধ্যে পরিবর্তন আসে।...যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, হলে আসন পাওয়ার জন্য নিজের স্বকীয়তা–মেরুদণ্ড সবকিছু বিকিয়ে দিতে হয়।
ছাত্ররাজনীতির প্রসঙ্গে আবদুল কাদের বলেন, রাজনীতি করা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু হলগুলোতে সেই দখলদারত্বের রাজনীতি থাকবে না। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি ক্যাম্পাসে থাকবে না।
মতবিনিময় সভায় মুক্ত আলোচনায় ক্যাম্পাসভিত্তিক নানা বিষয় তুলে ধরেন উপস্থিত শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা।