১৯৭৪ সাল, ১০ হাজার টাকা ঋণ ও সানবিমসের গল্প

সানবিমস স্কুল
সানবিমস স্কুল

শিক্ষাবিদ নিলুফার মঞ্জুর ইংরেজি মাধ্যমের সানবিমস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজেদের বাসায়, ১৯৭৪ সালে। চার দশকের বেশি সময় আগে ১৫ জন শিক্ষার্থীর সেই ছোট বিদ্যালয়টিকে তিনি গড়ে তুলেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে। তাঁর মৃত্যুতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

স্বাধীনতার পর সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ও নিলুফার মঞ্জুর দম্পতি থাকতেন ঢাকার ইন্দিরা রোডে। সানবিমস কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯৭৩ সালে নিলুফার মঞ্জুর দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য কিছু করার চিন্তা থেকে স্কুল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। এতে উৎসাহ দেন স্বামী সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ও তাঁর (নিলুফার মঞ্জুর) বন্ধুরা।

এগিয়ে আসে জনতা ব্যাংক। তারা নিলুফার মঞ্জুরকে ১০ হাজার টাকা ঋণ দেয়। এ টাকা দিয়ে তিনি ১০টি ডেস্ক ও বেঞ্চ কেনেন। সেগুলো রাঙানো হয়েছিল লাল রঙে, যেটি সমৃদ্ধির রং। ১৯৭৪ সালের ১৫ জানুয়ারি সকাল ৮টায় নিলুফার মঞ্জুর ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন ‘সানবিমস’ (সূর্যকিরণ), প্রথম ঘণ্টা বাজান তাঁর বিদ্যালয়ের।

সকালে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী অফিসে গেলে নিলুফার মঞ্জুর, তাঁর সহকর্মী ফরিদা তাহের (প্রয়াত) ও মুস্তারি খান লিভিং রুমের আসবাব সরিয়ে সেখানে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। ১৫ জন শিক্ষার্থীর বয়স ছিল ৪ থেকে ৮ বছর। ক্লাস শেষে নিলুফার ও তাঁর সহকর্মীরা বেঞ্চ সরিয়ে আবার আসবাব সাজিয়ে রাখতেন।

১৯৯৬ সালে সানবিমস জিসিই অর্ডিনারি লেভেল কোর্সগুলো চালু করে। তাদের প্রথম ‘ও’ লেভেল ব্যাচ পাস করে ১৯৯৮ সালে। ২০০৭ সালে সানবিমস উত্তরায় নিজেদের ক্যাম্পাসে যায়, যার আয়তন ২ একর। ২০০৮ সালে তাদের প্রথম ব্যাচ ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করে। এখন সানবিমসের দুটি ক্যাম্পাস, একটি ধানমন্ডি ও অন্যটি উত্তরায়।

ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সানবিমসের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ১০০ জনের বেশি। শিক্ষকের সংখ্যা ১৬১ জন।

নিলুফার মঞ্জুর সোমবার দিবাগত রাতে সবাইকে ছেড়ে চিরবিদায় নেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিলুফার মঞ্জুর সানবিমসের সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর পদ ছিল ‘হেড অব স্কুল’। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত স্কুলে গিয়ে নিয়মিত অফিস করেছেন। সংক্রমণ শুরুর পর স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু নিজের বাসা থেকেই সব কার্যক্রম তদারকি করতেন।

নিলুফার মঞ্জুরের স্বামী সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, ছেলে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, মেয়ে মুনিজে মঞ্জুর, পুত্রবধূ সামিয়া হক, ছয় নাতি-নাতনি, বোন ইয়াসমিন হক, ভাই জামশেদ চৌধুরী, অসংখ্য বন্ধুবান্ধব ও অগণিত গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর বাবা ড. মফিজ আলী চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭২ সালের মন্ত্রিসভার সদস্য।

নিলুফার মঞ্জুরের স্বামী সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। নিজের প্রতিষ্ঠিত অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ও রপ্তানি খাতের শীর্ষস্থানীয় চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। অ্যাপেক্স গ্রুপের নানা ব্যবসা রয়েছে।

মঞ্জুর এলাহী ও নিলুফার মঞ্জুরের ছেলে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ব্যবসায়ীদের প্রভাবশালী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি। মেয়ে মুনিজে মঞ্জুর অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের পরিচালক।

অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের মহাব্যবস্থাপক মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। তবে তাঁর শরীরে করোনাভাইরাসের তেমন কোনো লক্ষণ নেই। তিনি বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।

নিলুফার মঞ্জুরকে নিউমোনিয়ার লক্ষণসহ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষার পর করোনা ধরা পড়ে। এরপর পরিবারের সবাইকে পরীক্ষা করা হয়। মঞ্জুর এলাহী ছাড়া আর কারও করোনা ধরা পড়েনি।

পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সরকারের সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিলুফার মঞ্জুরের জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাঁর পরিবার সবার কাছ থেকে তাঁর আত্মার জন্য দোয়া চেয়েছেন।

নিলোফার মঞ্জুর

এদিকে নিলুফার মঞ্জুরের মৃত্যুর খবরে তাঁর স্বজন, সানবিমসের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা কর্মী, পরিচিত জন ও গুণগ্রাহীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

৩৭ বছর ধরে নিলুফার মঞ্জুরের সঙ্গে কাজ করা সানবিমসের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবদুল কাদের বলেন, ‘আমরা কখনো তাঁকে ম্যাডাম ডাকতে পারতাম না। আমাদের বলতেন আপা ডাকতে। আমাদের মনে করতেন নিজের পরিবারের সদস্য। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে তিনি নিজের সন্তান বলে মনে করতেন।’ তিনি বলেন, ‘আপা অতুলনীয়। তাঁর অভাব কোনো দিন পূরণ হবে না।’

সানবিমসের দুই শিক্ষার্থীর মা নাদিয়া রহমান বলেন, ‘সকালে খবরটি শোনার পর থেকে আমার মনে হচ্ছে আমি পরিবারের এক সদস্য হারিয়েছি। তিনি (নিলুফার মঞ্জুর) নৈতিকতা, মূল্যবোধ—সব দিক দিয়ে ছিলেন অনন্য।’