দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) ছাত্রদের কাছে ব্যান্ডের গান মানে সবার আগে ‘টার্বো ক্রেটার’। ক্যাম্পাসের এই ব্যান্ড কয়েক বছর ধরে মঞ্চ মাতাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা দিনাজপুর জেলার গণ্ডি পেরিয়ে সম্প্রতি ঢাকায়ও গান করে গেছে তারা।
‘টার্বো ক্রেটার’-এর সদস্যদের সঙ্গে কথা হলো ব্যান্ড নিয়ে। আড্ডা শুরু হলো প্রথম দিককার গল্প দিয়ে। ‘ছোটবেলা থেকে আমি রক আর মেটাল মিউজিকের ফ্যান। ইচ্ছা ছিল নিজে কিছু করার,’ বলা শুরু করলেন ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য রাজেশ কুমার দাস। বাকি সদস্যদের কাছে তিনি ‘রিংকুদা’। ‘২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর আমার মতো আরও দুজনকে খুঁজে বের করলাম। উইলিয়াম হেমব্রোম আর হামীম চৌধুরীকে নিয়ে একটা ব্যান্ড তৈরি করে ফেললাম। অনেক খোঁজার পর আমাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইদের একটা ব্যান্ডের সন্ধান পেলাম। তাঁরা তাঁদের প্যাড ব্যবহারের অনুমতি দিলেন। সেখান থেকে শুরু। উইলিয়াম গিটার বাজাত আর হামীম ছিল মূল ভোকাল। আমি ড্রাম বাজানোর পাশাপাশি ব্যাকআপ ভোকাল ছিলাম। পরে আমাদের সঙ্গে বেজিস্ট বিজেয় গুরুং যোগ দেয়। এই চারজন মিলেই মূলত আমাদের যাত্রা।’
এত নাম থাকতে টার্বো ক্রেটার কেন? রিংকু বললেন, ‘আমরা বেশির ভাগই কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র ছিলাম। প্রোগ্রামিংয়ের জন্য একটা “আইডিই” থেকে আমরা এই নাম পাই। তখন অবশ্য ব্যান্ডের নাম ছিল “টার্বো সি”। পরে তা বদলে “টার্বো ক্রেটার” রাখি। এর অর্থ আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ।’
বয়স হিসাব করলে ব্যান্ডের বয়স এখন ৬। পথচলাটা সহজ ছিল না টার্বো ক্রেটারের জন্য। ২০১২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সময়টা বেশ ভালোভাবে কাটিয়েছে তারা। নিয়মিত মঞ্চে গান করত। কিন্তু এরপরই কেমন যেন পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। প্রায় পুরো এক বছর নিষ্ক্রিয় ছিল ব্যান্ডটি। এরপর আবার জেগে উঠতে শুরু করে টার্বো ক্রেটার।
ব্যান্ডের অন্যতম সিনিয়র সদস্য নাসিম আহমেদ। বন্ধুদের কাছে পরিচিত ‘মনি’ নামে। বলছিলেন, ‘আমি যখন টার্বো ক্রেটারে যোগ দিই, তত দিনে ব্যান্ডের বয়স ৩ বছর হয়ে গেছে। সবচেয়ে ছোট ছিলাম বলে শুরুতে আমার ওপর কোনো রকম চাপ ছিল না। ২০১৬ সালের দিকে উইলিয়াম ভাই আর বিজেয়দা পড়ালেখার চাপে খুব বেশি সময় দিতে পারছিলেন না। এমন সময় লিড গিটারিস্ট শাহরিয়ার আহমেদ এবং বেজিস্ট ভাগ্যবন্ধু রায় যোগ দেয়। ব্যাকআপ গিটারের জন্য পাই তানজীর ফেরদৌস রক্তিমকে। আর আমি লিড গিটারিস্ট তো আছিই।’ বলতে বলতে নাসিম আহমেদ স্মৃতিকাতর হলেন, ‘মাঝে নাইমুর রহমান রতন ভাই কিছুদিন ভোকাল ছিলেন। এখানে রিংকুদার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেই হয়। পড়ালেখা শেষ হয়ে গেলেও এখনো ব্যান্ডের মূল ভোকাল তিনি। ব্যান্ডের সঙ্গে থেকে সবাইকে আগলে রাখার কাজটা তিনি নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন।’
নতুন সদস্য নেওয়ার বেলায় বেশ কিছু দিক খেয়াল রাখা হয় বলে জানালেন তাঁরা। ‘আমরা সবাই নিজেদের একে অপরের খুব ভালো বন্ধু মনে করি। তাই নতুন সদস্য হিসেবে কাউকে নেবার আগে তার দক্ষতার পাশাপাশি তার সঙ্গে বোঝাপড়াটা কেমন হচ্ছে, সেটাও দেখা হয়। মিউজিকের জন্যও এই বোঝাপড়াটা জরুরি বলে আমরা মনে করি,’ নাসিম বললেন।
শুরুর দিকে টার্বো ক্রেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বেশি কনসার্ট করত। গত দুই বছরে তাদের কাজের পরিধি আরও বেড়েছে। এখন নিয়মিত বাইরে অনুষ্ঠান করে তারা। গত বছর নিজেদের ক্যাম্পাসে দিনাজপুরে প্রথমবারের মতো একটা ‘রকফেস্ট’ করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও ‘রকফেস্ট’ হয়েছে দিনাজপুরে।
রিংকু জানালেন, ‘টার্বো ক্রেটার আসলে এখন আর দিনাজপুরের গণ্ডির মধ্যে আটকে নেই। এর প্রমাণ হলো গত আগস্টে রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড কনসার্টে আমাদের অংশগ্রহণ। যেহেতু পরিধি বেড়েছে, আমরাও অনুপ্রাণিত হয়েছি।’
অনুপ্রেরণা নিয়ে কথা বলতে গেলে ভক্তদের প্রসঙ্গ আসে। নাসিম বললেন, ‘ভক্তরাই তো অনুপ্রেরণা দেয়। বছরখানেক আগে আমরা ব্যান্ডের টি-শার্ট, হুডি বানিয়েছিলাম। খুবই অবাক হয়েছি যখন শুধু নিজ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা দিনাজপুর জেলা না, বরং সারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তরা সেগুলো অর্ডার করেছিল। তাদের সমর্থন আমাদের মধ্যে ভালো গান করার দায়িত্ববোধটাও বাড়িয়ে দেয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ব্যান্ড এত দিন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, ক্যাম্পাস প্রশাসনের সাহায্য ছাড়া নিশ্চয়ই এটা সম্ভব হতো না। রিংকু বললেন, ‘আসলেই তাই। আগে আমরা একটা কফিশপে প্যাড করতাম। কিন্তু অনেক শব্দ হওয়ায় সেখানে বেশি দিন টিকতে পারিনি। পরে ২০১৪ সালে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা পরিত্যক্ত ঘর জোগাড় করি আমরা। সেটাই এখন আমাদের প্র্যাকটিস প্যাড।’
কথায় কথায় ভবিষ্যতের প্রসঙ্গ এল। নাসিম বললেন, ‘আমরা ওয়ারফেজ আর আর্টসেলের প্রতি একটা ট্রিবিউট মিউজিক রিলিজ করেছিলাম। সামনে সে ধরনের কিছু করার ইচ্ছা আছে। আর অ্যালবাম প্রকাশের পরিকল্পনা তো আছেই। আমরা আসলে সারা বিশ্বের শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে চাই। শুধু দিনাজপুর কিংবা বাংলাদেশ না। অনেক বড় স্বপ্ন দেখি।’