‘পুরস্কার পাব, কিন্তু সেটা কেউ হাতে তুলে দিতে পারবেন না, এটা ভেবে মন কিছুটা খারাপ ছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা মেনে নিতে হয়েছে। জাতীয় গণিত উৎসবে ঢাকায় আসব, সবার সঙ্গে পরিচয় হবে, জ্ঞানী–গুণীদের সঙ্গে দেখা হবে—সব মিলিয়ে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করত,যেগুলো এবার হয়নি।’ কথাগুলো শাহরিয়ার হোসেনের। রংপুর জিলা স্কুলের শাহরিয়ার এবার জাতীয় গণিত উৎসবে জুনিয়র ক্যাটাগরিতে সেরাদের সেরা হয়েছে। তবে ছোটবেলায় গণিত বিষয়টি তার কাছে খুবই ‘বোরিং’ লাগত। শিশুশ্রেণিতে থাকার সময় একবার নাকি অঙ্কে বেশ খারাপও করেছিল সে।
শাহরিয়ারের সঙ্গে যৌথভাবে জুনিয়র ক্যাটাগরিতে সেরাদের সেরা হয়েছে তাহমিদ আরমান। ঢাকার স্যার জন উইলসন স্কুলের ছাত্র তাহমিদ গণিতের সমস্যা সমাধান করতে ভালোবাসে। সময় পেলেই বসে যায় ইউটিউবের সামনে। গণিতের বিভিন্ন ভিডিও দেখে তা সমাধানের চেষ্টা করে। যখন কোনো সমস্যার সঠিক সমাধান করতে পারে, তখন খুবই ভালো লাগে তাহমিদের। এবারের উৎসব অনলাইনে হওয়ার কারণে অবশ্য শাহরিয়ারকে একটু ভুগতে হয়েছিল। কারণ, সময় যখন খুব শেষের দিকে তার তখনো একটি প্রশ্নের সমাধান করা বাকি। ঠিক সে সময় মুঠোফোনে একটা কল চলে আসে, তাই শেষ পর্যন্ত আর অঙ্কটির সমাধান করতে পারেনি। তবে ফল ঘোষণার পর যখন ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস’-এ নিজের নাম শুনতে পেল, তখনই কেটে যায় সেই একটা প্রশ্ন ছেড়ে দেওয়ার আক্ষেপ। গণিতে পিএইচডি করার পাশাপাশি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ওপর পড়াশোনা করার ইচ্ছা তাহমিদের।
প্রাথমিক ক্যাটাগরি থেকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস’ হওয়া রাফসান সোবহান খোলা মাঠে আয়োজিত সেই গণিত উৎসবের জাতীয় পর্যায়কে মিস করেছে ভীষণভাবে। ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী রাফসান লকডাউনের পুরো সময় গণিতের সমস্যা সমাধান করে কাটিয়েছে। বড় হয়েও গণিতের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা আছে কি না জানতে চাইলে রাফসান বলে, ‘প্রবলেম সলভ করতে আমার ভালো লাগে। যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে যখন কোনো প্রবলেম সলভ করি, তখন একধরনের ভালো লাগা কাজ করে নিজের মধ্যে। আগামী দিনে গণিত নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ আমার।’
‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস’ হওয়া প্রায় সবাই এ বছর মাঠের গণিত উৎসবকে মিস করেছে। অনলাইনে উৎসবের আমেজ না থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে এই নতুন স্বাভাবিককে মেনে নিয়েছে সবাই। গণিতের মতো একটি ‘কাঠখোট্টা’ বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা কীভাবে জন্মাল, তা জানতে চেয়েছিলাম মাধ্যমিক ক্যাটাগরি থেকে সেরাদের সেরা হওয়া তাহমিদ হামীম চৌধুরীর কাছে। ‘গণিত কখনোই রসহীন বিষয় নয়। যুক্তি দিয়ে যখন একটি সমস্যার সমাধান করতে পারবেন, দেখবেন, অঙ্ক আপনার কাছে আপনা–আপনি ভালো লাগতে শুরু করবে।’ এভাবেই গণিতের প্রতি নিজের ভালোবাসার কথা জানাল তাহমিদ। নিবন্ধন থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পুরো প্রক্রিয়াই ছিল এবার অনলাইনকেন্দ্রিক। তাই প্রশ্ন কেমন হবে? উত্তর কীভাবে দেব? অনুশীলন কেমন করে করব? এই নিয়ে কিছুটা সন্দিহান ছিল ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী তাহমিদ। তবে ধীরে ধীরে সেসব সমস্যা কাটিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে মাধ্যমিক ক্যাটাগরি থেকে ‘সেরাদের সেরা’ স্থান অর্জন করে।
‘অন্য বছরগুলোয় পরীক্ষা শেষ করে সবার সঙ্গে প্রশ্ন মিলিয়ে দেখতাম, কে কোনটা কীভাবে করেছে, তা দেখে যদি মিলে যেত, তাহলে ভীষণ ভালো লাগত, আবার যদি না মিলত, তবে মন খারাপ হতো। এভাবেই দিন শেষে বিজয়ী ঘোষণার আগমুহূর্ত পর্যন্ত এ নিয়ে সবার মধ্যে একধরনের উত্তেজনা কাজ করত। কিন্তু এই বিষয়গুলো এবার ছিল না,’ বলল রাইয়্যান। উচ্চ মাধ্যমিক ক্যাটাগরি থেকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস’ হওয়া নটর ডেম কলেজের রাইয়্যান জামিলের গল্পটা সবার থেকে একটু আলাদা। কেননা, প্রতিযোগী হিসেবে গণিত অলিম্পিয়াডে আর অংশগ্রহণ করতে পারবে না সে। এবারের আয়োজনসহ মোট আটবার সে অংশ নিয়েছে গণিত উৎসবে। রাইয়্যান বলে, ‘ক্লাস টু কিংবা থ্রিতে থাকতে যোগ-বিয়োগ শেখার সময় বাবা গুণ করা শিখিয়েছিলেন। যোগের সঙ্গে গুণের একটি সহজ কৌশল তখন শিখেছিলাম, সেই থেকে গণিতের প্রতি একধরনের ভালোবাসা জন্মায়।’
গত জানুয়ারি মাসে সারা দেশের ৬৯ হাজার ১৯০ শিক্ষার্থী গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে নিবন্ধন করে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাছাইপর্বে নির্বাচিত হয় ১৩ হাজার ৬২০ জন। তাদের নিয়ে মে মাসে আঞ্চলিক পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এই পর্বে বিজয়ী ১ হাজার ৩১২ জনকে নিয়ে ৩ জুলাই জাতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। নিবন্ধন থেকে জাতীয় পর্ব পর্যন্ত সব আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়েছে অনলাইনে। জাতীয় উৎসবের বিজয়ীদের মধ্য থেকে নির্বাচিতদের নিয়ে অনলাইনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে গণিত ক্যাম্প। তাদের মধ্যে নির্বাচিত সেরা ৬ শিক্ষার্থী আগামী ২১-২২ সেপ্টেম্বর অনলাইনে অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেবে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি গণিত উৎসবের আয়োজন করেছে।