পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত পরিদর্শন ও নিরীক্ষায় এসব জালিয়াতি ধরা পড়েছে।
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের জাল সনদ দাখিল করেছেন ৭৯৩ জন।
কম্পিউটার শিক্ষার ভুয়া সনদ দেখিয়েছেন ২৯৬ জন।
৬৭ জনের বিএড, গ্রন্থাগার, সাচিবিক বিদ্যা ও অন্যান্য বিষয়ের সনদ জাল।
হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ছাতিয়াইন বিশ্বনাথ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজটি বেসরকারি। এই প্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক স্নিগ্ধা রানী দাস সরকারি বেতনভুক্ত (এমপিও বা মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) হন ২০১২ সালে। এরপর থেকে তিনি সরকারের কাছ থেকে মাসে মাসে বেতন পেয়ে আসছেন। অথচ তিনি শিক্ষক হওয়ার জন্য বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) যে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ দিয়েছেন, সেটি ভুয়া।
এই ভুয়া সনদের বিষয়টি ধরা পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) নিরীক্ষায়। ওই সনদ সঠিক কি না, তা এনটিআরসিএর মাধ্যমে যাচাই করে ডিআইএ জানতে পারে স্নিগ্ধা রানী দাসের সনদে যে নম্বর লেখা, সেটির বিপরীতে প্রকৃত সনদধারী হলেন দেলোয়ার হোসাইন চৌধুরী। স্নিগ্ধা রানীর নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি।
ডিআইএর সুপারিশ অনুযায়ী, স্নিগ্ধা রানীকে এখন সরকারের কাছ থেকে নেওয়া সমুদয় বেতন-ভাতা ফেরত দিতে হবে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিদর্শন চলা পর্যন্ত তিনি বেতন-ভাতা নিয়েছিলেন ১০ লাখ টাকার কিছু বেশি।
ডিআইএ ছাতিয়াইন বিশ্বনাথ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজটি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিদর্শন করলেও যাচাই–বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দেয় গত জানুয়ারিতে।
জাল সনদের মাধ্যমে এমপিওভুক্তি ঠেকানোর একটি কার্যকর উপায় হতে পারে অনলাইনেই সনদ যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা।অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক, সাবেক মহাপরিচালক, মাউশি
শুধু ওই শিক্ষক নন, ডিআইএ ২০১৩ সাল থেকে ২৫ মে পর্যন্ত সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে মোট ১ হাজার ১৫৬ জন শিক্ষকের শিক্ষাগত এবং যোগ্যতার সনদ ভুয়া বলে তথ্য পেয়েছে। এ জন্য ওই সব শিক্ষককে দেওয়া বেতন-ভাতা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
জাল সনদ দেখিয়ে চাকরি অথবা এমপিওভুক্ত হওয়া শিক্ষকদের কাছ থেকে মোট কত টাকা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, তা জানা যায়নি। তবে কয়েকটি বিভাগের তথ্য পাওয়া যায়। যেমন খুলনা ও বরিশাল বিভাগে জাল সনদে শিক্ষক হয়ে বেতন নেওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ডিআইএ শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন এবং আর্থিক স্বচ্ছতা আনতে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করে। ডিআইএর পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর প্রথম আলোকে বলেন, ডিআইএর পক্ষ থেকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
একসময় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে পরিচালনা কমিটির একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল। এখন এনটিআরসিএর মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। এনটিআরসিএর বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন সনদ ছাড়া শিক্ষক হওয়ার সুযোগ নেই। ডিআইএর প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, যে ১ হাজার ১৫৬ জন শিক্ষকের সনদ জাল বলে পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে ৭৯৩ জন এনটিআরসিএর শিক্ষক নিবন্ধনের ভুয়া সনদ দেখিয়েছেন। অন্যদের মধ্যে ২৯৬ জনের কম্পিউটার শিক্ষার সনদ এবং ৬৭ জনের বিএড, গ্রন্থাগার, সাচিবিক বিদ্যা ও অন্যান্য বিষয়ের সনদ জাল।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে এনটিআরসিএর ভুয়া সনদ দাখিল করা শিক্ষক রয়েছেন ৪৪৩ জন। ঢাকা ও ময়মনসিংহে ৩৬৬ জন, খুলনা ও বরিশালে ২৫১ জন এবং চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ৯৬ জন শিক্ষকের সনদ জাল।
জাল সনদের একটি উদাহরণ পাওয়া যায় চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার নিশ্চিন্তপুর উচ্চবিদ্যালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। গত বছরের অক্টোবরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই প্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক আবু সুফিয়ান ২০১২ সালের নভেম্বরে ভুয়া সনদ দেখিয়ে চাকরি পান।
ডিআইএর প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, যে ১ হাজার ১৫৬ জন শিক্ষকের সনদ জাল বলে পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে ৭৯৩ জন এনটিআরসিএর শিক্ষক নিবন্ধনের ভুয়া সনদ দেখিয়েছেন।
ডিআইএ চিঠি দেওয়ার পর গত বছরের মার্চে এনটিআরসিএ জানায় ‘সনদটি জাল ও ভুয়া।’ ডিআইএর সুপারিশ অনুযায়ী, আবু সুফিয়ান ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১১ লাখ টাকার বেশি বেতন-ভাতা নিয়েছেন। পরে যদি নিয়ে থাকেন, সেই বেতনসহ পুরো টাকা ফেরত দিতে হবে।
একইভাবে সনদ জাল সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার হরিণাহাটা মহিলা দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মো. মোশফেক ফারুকীর। হবিগঞ্জের ছাতিয়াইন বিশ্বনাথ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) মনির আহমেদ চৌধুরীর কম্পিউটার প্রশিক্ষণের সনদ ভুয়া।
জাল সনদধারী শিক্ষকদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে ছাতিয়াইন বিশ্বনাথ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হারুনুর রশীদ গতকাল শুক্রবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আর বেতন তুলতে পারছেন না। প্রতিষ্ঠানেও আসছেন না। ইতিমধ্যে বেতন বাবদ নেওয়া টাকা কীভাবে ফেরত আনা যায়, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মতামত পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শিক্ষক নিয়োগের পর এমপিওভুক্তির কাজটি হয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীনে। সঠিকভাবে যাচাই করে নিলে এমন ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
জালিয়াতি বন্ধ করার উপায় কী, জানতে চাইলে মাউশির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, জাল সনদের মাধ্যমে এমপিওভুক্তি ঠেকানোর একটি কার্যকর উপায় হতে পারে অনলাইনেই সনদ যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা। এটি শুরু হয়েছে।