কলেজের শ্রেণি কার্যক্রমের সময়সূচি নির্ধারিত বিকেল ৩টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত। কিন্তু ক্যাম্পাস প্রায় ফাঁকা হয়ে যায় দেড়টার মধ্যে। যেসব শ্রেণিকক্ষ খোলা থাকে সেগুলোর বেশির ভাগেই অনুষ্ঠিত হয় নানা ধরনের পরীক্ষা। এই চিত্র দেড় শ বছরের পুরোনো চট্টগ্রাম কলেজের।
কলেজে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস নিয়মিত হয়। তবে অন্যান্য শ্রেণিতে দুপুরের পরে ক্লাস হয় না বললেই চলে। ২২, ২৫ ও ২৭ আগস্ট সরেজমিনে দেখা এই দৃশ্য প্রায় প্রতিদিনের।
১৮৩৬ সালে চট্টগ্রাম জেলা স্কুল হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম। এর ৩৩ বছর পরে ১৮৬৯ সালে একে উচ্চমাধ্যমিকে উন্নীত করা হয়। তখন থেকেই এটি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ বা চট্টগ্রাম কলেজ নামে পরিচিতি পায়। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিরা এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। এই কলেজে উচ্চমাধ্যমিকসহ (বিজ্ঞান ও মানবিক শাখা) ১৭টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ানো হয়। এসব শ্রেণিতে শিক্ষার্থী আছেন প্রায় ২১ হাজার।
কেন ক্লাস হয় না
উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় ছাড়া অন্যান্য শ্রেণিতে ক্লাস কম হওয়ার পেছনে শিক্ষকেরা কয়েকটি কারণের কথা বলেছেন। একদিকে ছাত্রাবাসগুলো বন্ধ, অন্যদিকে পরিবহন সুবিধা নেই। ফলে চট্টগ্রামের আশপাশের উপজেলা থেকে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত কলেজে আসেন না। বেশ কিছু বিভাগে প্রয়োজনীয় শিক্ষক না থাকায় সব বিষয়ের ক্লাস হয় না।
এর সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই দুপুরের পর থেকে শ্রেণিকক্ষগুলো বরাদ্দ হয়ে যায় নানা ধরনের পরীক্ষার জন্য। তখন শিক্ষার্থীরা এলেও ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না। বর্তমানে বেলা একটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চট্টগ্রামের ১১টি কলেজের বিভিন্ন বিভাগের প্রথম বর্ষের হাজারো শিক্ষার্থীর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে কলেজের অন্তত ৪৪টি কক্ষ ব্যবহার হচ্ছে।
পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে করতে শিক্ষকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কলেজ শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক রেজাউল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সারা বছরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা শ্রেণির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শিক্ষকদের হলে দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে প্রায় সময় বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস স্থগিত করা হয়।
>দেড় শ বছরের পুরোনো চট্টগ্রাম কলেজ
কলেজে শিক্ষার্থী আছে প্রায় ২১ হাজার
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১: ১৪২
পরীক্ষার দায়িত্বপালনে ব্যস্ত শিক্ষকেরা
ক্লাস হয় কম, ছাত্রাবাস থেকেও যেন নেই
কলেজের বাংলা বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্র প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাড়ি বোয়ালখালী উপজেলায়। সেখান থেকে এসেই ক্লাস করেন। কিন্তু প্রায় সময় কলেজে এসে দেখেন পরীক্ষার জন্য ক্লাস স্থগিত করা হয়েছে। তাই তিনি সপ্তাহে এক–দুদিন আসেন।
কলেজে শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সমস্যা লেগেই থাকে। এসব সংকটের মধ্যেও উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলে এ কলেজ বহু বছর ধরে চট্টগ্রামে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ৮৩৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৮৩৩ জনই পাস করেছেন। তাঁদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫৫৫ জন।
কলেজের সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ মো. আবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, যেসব বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণি পর্যন্ত আছে সেগুলোতে অন্তত ১২ জন করে শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ বিভাগেই এত পদ সৃষ্টি হয়নি। যেগুলো সৃষ্ট হয়েছে সেগুলোর মধ্যেও অনেক শূন্য রয়েছে।
২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর এই কলেজের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনে শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ সংকটের কথা উঠে এসেছিল। তিন বছর পরে দেখা যাচ্ছে এসবের পরিবর্তন হয়নি।
শিক্ষক ও কক্ষ সংকট
বিভাগ অনুযায়ী কলেজে ২২৮ জন শিক্ষক থাকার কথা। তবে এখন পর্যন্ত পদ সৃষ্টি হয়েছে ১৭৪টি। কিন্তু শিক্ষক আছেন মাত্র ১৪৮ জন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:১৪২।
কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকের নয়টি পদ থাকলেও আছেন মাত্র চারজন। মনোবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির চার ছাত্রী সালেহা আকতার, জান্নাতুল ফেরদৌস, মারওয়া জেবিন ও তাসমিয়া নূর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে সাতটি করে বিষয় থাকলেও চারটি বিষয়ে পাঠদান করানো হয়। বাকি বিষয়গুলো নিজেদের আয়ত্ত করতে হয়েছে।
বাংলা বিভাগে ১০টি পদ থাকলেও শূন্য রয়েছে ৩টি। ৭ শিক্ষককে প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়মিত পাঠদান করাতে হয়। শিক্ষক সংকট রয়েছে ভূগোল, উদ্ভিদবিজ্ঞানসহ বেশ কয়েকটি বিভাগেও।
কলেজে বর্তমানে ৮টি ভবনে ৬০টির মতো কক্ষ আছে। কিন্তু এটি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন শিক্ষকেরা। তবে ৪০ কক্ষবিশিষ্ট দশতলার নতুন একটি একাডেমিক ভবনের কাজ শুরু হয়েছে।
কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবগুলো মোটামুটি সমৃদ্ধ হলেও যন্ত্রপাতির বেশির ভাগই পুরোনো। আর অধিক শিক্ষার্থীর কারণে সবাইকে ল্যাব সুবিধা পেতে ধৈর্য ধরতে হয়।
ছাত্রাবাস থেকেও যেন নেই
কলেজে চারটি ছাত্রাবাস ও দুটি ছাত্রীনিবাস রয়েছে। এর মধ্যে একটি ছাত্রীনিবাস সদ্য নির্মিত হয়েছে। বাকি পাঁচটি হল ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষের জের ধরে ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে।
সম্প্রতি কলেজের দুটি ছাত্রী নিবাস ও একটি ছাত্রাবাস খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব হলে আসন রয়েছে মাত্র ২৫৮টি। তবে বড় তিনটি ছাত্রাবাস খোলার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সেগুলো এখন প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী।
কলেজের সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ আবুল হাসান এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন। কলেজের বর্তমান ও অতীতের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন কলেজে পড়তাম তখন শিক্ষার্থীরা ছিলেন ক্লাসমুখী আর এখন দেখছি কোচিংমুখী। আমাদের সময়ে শিক্ষার্থীরা নিঃস্বার্থভাবে রাজনীতি করত। কিন্তু এখন দেখছি যারা রাজনীতি করছে তাদের কেউ কেউ নিজের স্বার্থ খুঁজছে।’