করোনা মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনা হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত শিখন ফল অর্জন করতে পারেনি। অ্যাসাইনমেন্ট, টেলিভিশন ও অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করা হলেও তা শ্রেণিকক্ষের মতো কার্যকর হচ্ছে না। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণ করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, এই ঘাটতি পূরণ করে শিক্ষার্থীদের পরের শ্রেণিতে ওঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মাধ্যমে পাঠ্যসূচি পুনর্বিন্যাস করে ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান শিক্ষাবর্ষের সময়ও প্রয়োজনে বাড়াতে হবে। জানুয়ারিতেই স্কুলশিক্ষার্থীদের ওপরের ক্লাসে ওঠানো যাবে না। প্রয়োজনে জানুয়ারির পরেও বর্তমান ক্লাসে আরও কয়েক মাস পড়িয়ে শিখন ফল অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে।
গত বছর মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ১২ সেপ্টেম্বর খুলছে দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে শুরুতে একসঙ্গে সব শ্রেণির ক্লাস হবে না। ধাপে ধাপে বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীর ক্লাস আগামী ১৫ অক্টোবরের পর শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও আলোচনা করে সেটিও এগিয়ে আনা হতে পারে। এ অবস্থায় শিখন ঘাটতি পূরণের বিষয়টি সামনে এসেছে।
এই ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা যায় তা নিয়ে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও ভাবছে। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আজ শনিবার বলেছেন, শ্রেণিকক্ষের পাঠদানের ষোলো আনা বিকল্প তো আর করা যায়নি। কোথাও কোথাও ঘাটতি রয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর সেই ঘাটতি পূরণের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও তাঁদের রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়াসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে এই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হবে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন আজ প্রথম আলোকে বলেন, এখন অ্যাসাইনমেন্ট, অনলাইন ও টেলিভিশন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম সচল আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর সেগুলো যাচাই করে কী কী ঘাটতি আছে, সেটা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ঘাটতি পূরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে আগামীকাল রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা ডাকা হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে খোলার পর যাচাই করে ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা নেবেন তাঁরা। কীভাবে সেই শিখন ঘাটতি চিহ্নিত করা হবে, সেই ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য বলছে, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করে প্রায় পৌনে দুই কোটি ছেলেমেয়ে। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটির কিছু বেশি। আর কলেজে মোট শিক্ষার্থী প্রায় অর্ধকোটি। বাকি শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যমসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে। কিন্তু দীর্ঘ বন্ধের কারণে ইতিমধ্যে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ক্ষতি হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা হয় শিক্ষাক্রমে থাকা নির্দেশনা মোতাবেক। শিক্ষার্থীদের কী পড়ানো হবে, কেন পড়ানো হবে, কে পড়বে, কারা পড়াবেন ও কীভাবে পড়াবেন, কতটুকু পড়বে এবং পড়ার ফলে কী হবে—সেসবের বিস্তারিত দিকনির্দেশনা থাকে শিক্ষাক্রমে। বিষয়, কাঠামো, নম্বর, ক্লাসের সময় ও সংখ্যাও ঠিক করা থাকে শিক্ষাক্রমে।
কিন্তু প্রায় দেড় বছর শ্রেণিকক্ষে ক্লাস না হওয়ায় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পড়াশোনা হয়নি। তেমনি পরীক্ষা না হওয়ায় যতটুকু পড়েছে তারও কোনো মূল্যায়ন হয়নি। কারণ, স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা থেকে শুরু করে পাবলিক পরীক্ষাগুলো বাতিল করতে হয়েছে করোনা সংক্রমণের কারণে।
এই পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমানের পরামর্শ হলো, ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীদের যে শিখন ঘাটতি হয়েছে, সেটি অবশ্যই পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এটি করতে হলে বিদ্যমান শিক্ষাবর্ষের সময় বাড়াতে হবে। যেমন, এখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা গত বছর ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রায় পুরো বছরই শ্রেণিকক্ষে যেতে পারেনি। ‘অটো-প্রমোশনের’ মাধ্যমে সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর এখন আট মাস চলে গেছে। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে যেতে পারেনি।
বিদ্যমান শিক্ষাবর্ষ অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারিতে এসব শিক্ষার্থীদের অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার কথা। কিন্তু সেটা করা যাবে না। এ জন্য পুনর্বিন্যাস করা পাঠ্যসূচিতে আগামী মার্চ পর্যন্ত পড়িয়ে শিখন ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এভাবে শেখার মূল বিষয়গুলোর ভিত্তিতে আট-নয় মাসের হিসাবে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করে শেখাতে হবে। আগামী কয়েক বছরে পরিস্থিতিটি স্বাভাবিক করতে হবে। কারণ, শিখন ঘাটতি রেখে ওপরের শ্রেণিতে ওঠানো হলে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হবে।