>
- স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচনে বিভক্তির কারণে পরাজয় ছাত্রলীগের
- পরেরটিতে ছাত্রলীগ জোট বাঁধে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে
- ভোট গ্রহণ হলেও গণনা হয়নি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রথম নির্বাচন হয় মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ২০ মে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সক্রিয় প্রধান দুটি সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। নীতির প্রশ্নে মতভেদের কারণে ছাত্রলীগ বিভক্ত হলে সরকারি ছাত্রসংগঠনের ভরাডুবি হয়। বিপুল বিজয় পায় ছাত্র ইউনিয়ন।
ঠিক এক বছরের মাথায় ১৯৭৩ সালে আগের ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জোট বাঁধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এই দুই ছাত্রসংগঠনের যৌথ প্যানেলের নাম দেওয়া হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদের প্রতিদ্বন্দ্বী আ স ম আবদুর রব–সমর্থিত জাসদ ছাত্রলীগের অবস্থানও ছিল বেশ শক্ত। ৩ সেপ্টেম্বর দিনভর নির্বিঘ্নে ভোট গ্রহণ হয়, সন্ধ্যায় ভোট গণনা শুরু হলে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। পরদিন ৪ সেপ্টেম্বর ইত্তেফাক-এর খবরে বলা হয়, ডাকসু নির্বাচনে গোলাগুলি, হলগুলোতে ছিনতাই করা হয়েছে ব্যালট বাক্স। এ ঘটনায় পরস্পরকে দোষারোপ করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও রবপন্থী জাসদ ছাত্রলীগ। স্থগিত হয় ভোট গণনা। বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালের পর আরও পাঁচবার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। টানা ২৮ বছর পর কাল সোমবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে অষ্টম ডাকসু নির্বাচন। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিএনপির সময় ১৯৭৯, ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদের সময়ে ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আজকের প্রতিবেদনে ফিরে দেখা হয়েছে ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচন।
প্রথম ডাকসুতে ছাত্রলীগের পরাজয়
১৯৭২ সালের সংবাদপত্রের প্রতিবেদন এবং তৎকালীন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম ডাকসু নির্বাচন, তখনকার পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সরকারি ছাত্রসংগঠনে বিরোধ থাকলেও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল আটটি ছাত্রসংগঠনের অংশগ্রহণে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৯ হাজার ৪০০। ভোট দেন ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী।
নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, যিনি এখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি। তখন সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মাহবুব জামান। তিনি এখন সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ডেটা সফটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
সেই সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া ‘শহীদ-মনির’ (শেখ শহীদুল ইসলাম ও মনিরুল হক চৌধুরী) পরিষদ কোনো আসনই পায়নি। শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন সিরাজপন্থী ছাত্রলীগের ‘জিনাত-মোয়াজ্জেম’ (জিনাত আলী ও মোয়াজ্জেম হোসেন) প্যানেল ডাকসুর একটি সদস্যপদ পায়।
মুজাহিদুল ইসলাম তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিরাজপন্থী ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী জিনাত আলীর চেয়ে ১ হাজার ১৭৬ ভোট বেশি পান। অন্যদিকে মাহবুব জামান ছাত্রলীগের একই প্যানেলের মোয়াজ্জেম হোসেনের চেয়ে ৮৮৩ ভোট বেশি পেয়ে বিজয়ী হন।
ডাকসুর অন্যান্য পদেও ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের চেয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ ভোট বেশি পেয়ে জয়লাভ করেন। ২০ মে ইত্তেফাক–এর খবরে বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসবমুখর পরিবেশের বর্ণনা পাওয়া যায়। নির্বাচন উপলক্ষে ফেস্টুন, রংবেরঙের পোস্টারে সাজানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন ও হল।
‘আজ নির্বাচন’ শিরোনামে ইত্তেফাক–এর মূল প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আজ ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশে বহু আন্দোলনের পাদপীঠ, স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্জয় দুর্গ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের আদর্শে উজ্জীবিত হইয়া ডাকসু ও হলসংসদসমূহের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিতেছে।’
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রলীগ কেন হেরেছিল প্রথম ডাকসু নির্বাচনে? এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওই নির্বাচনে ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম শনিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের পরাজয়ের একমাত্র কারণ ছিল নির্বাচনের আগে দলে বিভক্তি। ছাত্রলীগ ভেঙে তখন জাসদ ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ডাকসু নির্বাচনের মাস দুয়েক আগে এই ভাঙনের কারণে নেতা–কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া দ্বিধাদ্বন্দ্বের সুফল পায় ছাত্র ইউনিয়ন।
এই বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করে মুজাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ বিভক্ত না হলেও আমরা ওই নির্বাচনে জিততাম। মুজিববাদী ও জাসদ ছাত্রলীগের প্রার্থীদের চেয়েও ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থীরা বেশি ভোট পেয়েছিলেন। ডাকসু ছাড়াও চাকসু, রাকসুসহ বিভিন্ন ছাত্র সংসদে তখন ছাত্র ইউনিয়ন বিজয়ী হয়। ’
প্রথম ডাকসু নির্বাচনে আটটি প্যানেল অংশ নেয়। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (রব), বাংলা ছাত্রলীগ, বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, ফরোয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লক ও সাম্রাজ্যবাদী ছাত্র জোট।
১৯৭৩: ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন জুটি
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দ্বিতীয় নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। ওই নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হলেও ফল ঘোষণা হয়নি। প্রথম নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জোট বাঁধে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে, যৌথভাবে গড়ে তোলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র ইউনিয়নের নূহ-উল–আলম লেনিনকে সহসভাপতি ও ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামাকে সাধারণ সম্পাদক করে ডাকসু নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ ছাত্রলীগের পক্ষে সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মাহবুবুল হক ও জহুরুল ইসলাম।
তা ছাড়া ওই নির্বাচনে অংশ নেয় বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন, গাঁজাতান্ত্রিক ছাত্র জোট ও রাজা–উজির পরিষদ।
৪ সেপ্টেম্বর ইত্তেফাক–এর খবরে বলা হয়, ‘ডাকসু নির্বাচনে গোলাগুলি: ব্যালট বাক্স ছিনতাই’। একই দিনে বাংলাদেশ অবজারভার-এর খবরে গোলাগুলির ঘটনা নিয়ে বলা হয়, ‘মুখোশ পরে অস্ত্রধারী একটি দল সন্ধ্যা সাতটায় সলিমুল্লাহ হলে প্রথম গোলাগুলি করে।’
ওই নির্বাচনে ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের জোট বাঁধা নিয়ে নানামুখী আলোচনা রয়েছে। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নির্বাচিত ডাকসুর তখনকার ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন ঐক্য ও সংগ্রামের নীতিতে আমরা ঐক্যের ওপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ছাত্রলীগ থেকে বের হয়ে জাসদ ছাত্রলীগ বামপন্থা ও বিপ্লবের হাওয়া নিজেদের দিকে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। এ জন্য ছাত্রলীগকে নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ করা হয়।’
নির্বাচন বানচাল হওয়া প্রসঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ১৯৭৩ সালে ভোট গণনার সময় দেখা গেল, বেশির ভাগ হলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ হেরে যাচ্ছে। তখনই ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ডাকসুর ভিপি হিসেবে পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এ ঘটনার জন্য প্রতিপক্ষ জাসদ ছাত্রলীগকে দায়ী করেছিলেন।
আসলে কে বা কারা ব্যালট ছিনতাই করেছিল—জানতে চাইলে মুজাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক জীবনে এই একবার আমি মিথ্যাচার করেছি। আসলে সেদিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সমর্থনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়েছিল। কিন্তু সংবাদ সম্মেলন করে জাসদ ছাত্রলীগকে ওই ঘটনায় দায়ী করার জন্য এরপর আমি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছি।’
অবশ্য ১৯৭২ সালের ডাকসু নির্বাচনে মুজাহিদুল ইসলামের প্রতিপক্ষ শেখ শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭৩ সালে ব্যালট বাক্স কারা ছিনতাই করেছিল, তা পরবর্তীকালে নিরূপণ করা হয়নি। তবে তিনি মনে করেন, ছাত্রলীগ বা ছাত্র ইউনিয়ন এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল না।