করোনা মহামারির জেরে অষ্টম শ্রেণির অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে মধ্যম ও উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ শিখন ঘাটতি চিহ্নিত করার পাশাপাশি তা পূরণে একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বেডু)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতেই অনেকটা সময় চলে গেছে। তাই এখনই এসব সুপারিশসহ আরও যা করণীয়, তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের কতটুকু শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা নিরূপণে বেডুর মাধ্যমে গবেষণা পরিচালনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০২১ শিক্ষাবর্ষে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে কী মাত্রায় শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা উঠে এসেছে গবেষণায়। এসব শিক্ষার্থী এখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। তারা ২০২৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
গবেষণার তথ্য বলছে, বাংলায় ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যম মাত্রায় ও ২৪ শতাংশের উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি রয়েছে। বাংলায় স্বল্পমাত্রায় শিখন ঘাটতি থাকা শিক্ষার্থী ২৫ শতাংশ। ইংরেজিতে মধ্যম মাত্রায় শিখন ঘাটতি থাকা শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৮ শতাংশ, উচ্চমাত্রায় ১৮ শতাংশ এবং স্বল্পমাত্রায় শিখন ঘাটতি রয়েছে ২০ শতাংশ। গণিতে মধ্যম মাত্রায় শিখন ঘাটতি রয়েছে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর, উচ্চমাত্রার ক্ষেত্রে তা ৩৯ শতাংশ এবং স্বল্পমাত্রার ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ।
বেডু বলছে, মধ্যম ও উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এ জন্য শিক্ষকদের মতামতের পাশাপাশি শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ও মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ওই ঘাটতি পূরণে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।
বেডু বলছে, শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের ঘাটতি পূরণে কেন্দ্রীয়ভাবে কার্যক্রম হাতে নেওয়া প্রয়োজন। এর অংশ হিসেবে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম, যেমন টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার, অনলাইন ক্লাস ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়সূচির ভিত্তিতে টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচারের পাশাপাশি একটি ইউটিউব চ্যানেল খুলে সেখানে ক্লাসগুলো আপলোড করার পরামর্শ দিয়েছে বেডু। এসব ক্লাস সাজানোর দায়িত্ব যৌথভাবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ও বেডুকে দেওয়া যেতে পারে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজ নিজ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আলাদাভাবে বাধ্যতামূলকভাবে অতিরিক্ত ক্লাসে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বেডু বলছে, জেলা পর্যায়ে অতিরিক্ত ক্লাসের ধরন নির্বাচনের (প্রত্যক্ষ বা অনলাইন ক্লাস) ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা দেওয়াই সমীচীন হবে। কারণ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতায় ভিন্নতা আছে। জেলা পর্যায়ের অতিরিক্ত শ্রেণি কার্যক্রম জেলা শিক্ষা কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করতে হবে।
বেডু বলছে, যেসব জেলায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী উচ্চ শিখন ঘাটতির কবলে পড়েছে, (যেমন: রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, কুমিল্লা) সেখানে প্রত্যক্ষ শ্রেণি কার্যক্রমের চেয়ে অনলাইন ক্লাস বা বিকল্প ব্যবস্থার ওপর বেশি জোর দিতে হবে। কারণ, এসব জেলায় অতিরিক্ত ক্লাসের জন্য প্রচুর স্কুলঘণ্টা প্রয়োজন হবে, যা প্রত্যক্ষ শ্রেণি কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এ কার্যক্রমে সম্ভব হলে এসব জেলায় দ্রুত খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে বলেছে বেডু। এসব জেলায় নিবিড় পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া স্বল্পমাত্রার শিখন ঘাটতি পূরণে নবম-দশম শ্রেণির ক্লাসের শুরুতেই অষ্টম শ্রেণিতে ছিল এমন প্রাসঙ্গিক ও সম্পর্কিত বিষয়বস্তুর ওপর আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্বালোচনা করার সুপারিশ করেছে বেডু।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অনলাইন শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুবিধা পাওয়া শিক্ষার্থীরা সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের চেয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ভালো করেছে। তাই যেকোনো ধরনের অনলাইন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। বৈষম্যের মাত্রা কমিয়ে আনার জন্য সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জন্য ডিভাইস প্রাপ্তি ও ইন্টারনেট–সংযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। অনলাইন শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনায় শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষকেরা চলমান অতিরিক্ত শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার পাশপাশি সশরীর ও অনলাইন (ব্লেন্ডেড লার্নিং প্রোগ্রাম) শিখন কার্যক্রমে ভূমিকা রাখতে পারবেন। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা একটি ধারাবাহিক শিখন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে উচ্চতর শিক্ষা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। যেখানে ক্রমে সহজ থেকে জটিল বিষয়ের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে। এ শিখন পরিক্রমার যেকোনো পর্যায়ের শিখন ঘাটতি শিক্ষার্থীর জীবনব্যাপী শিক্ষা গ্রহণের সক্ষমতা এবং উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই এ গবেষণায় চিহ্নিত শিখন ঘাটতি পূরণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে চিহ্নিত ঘাটতি কতটা পূরণ হলো, তা যাচাই করার জন্য ভবিষ্যতে একাধিক মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান প্রথম আলোকে বলেন, শিখন ঘাটতি পূরণে দুটো বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির খুব প্রয়োজন। প্রথমত, এমনভাবে শিখনঘণ্টা ব্যবস্থাপনা করতে হবে, যাতে মুখোমুখি শ্রেণি শিখনের বাইরেও বাড়ি বা এলাকাভিত্তিক শিখনচর্চা করা যায়। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাক্রম বা পেডাগজিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি, যার মাধ্যমে মূল যোগ্যতাগুলোর ভিত্তিতে বিষয় গুচ্ছ করে শিখনের চর্চা করা। এতে করে শিখন ঘাটতি পূরণে সময় কম লাগবে এবং নতুন শ্রেণি কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটবে না।