করোনাকালের শিক্ষা

শিক্ষাজীবন স্বাভাবিক করতে গুচ্ছ পরিকল্পনা

এসএসসি জুনে, এইচএসসি জুলাই-আগস্টে। ফেব্রুয়ারি থেকে শ্রেণিকক্ষে ক্লাস। আটকে থাকা এইচএসসির মূল্যায়ন জানুয়ারিতে। কয়েক দিনে বই বিতরণ।

ফাইল ছবি

করোনার কারণে অনিশ্চয়তার মুখে পড়া শিক্ষাজীবনকে নতুন বছরে স্বাভাবিক করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে প্রথমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফেরানো হচ্ছে। এই দুই পরীক্ষার সম্ভাব্য সময়ও ঠিক করা হয়েছে। উৎসব করে না হলেও ১ জানুয়ারি থেকে মধ্য জানুয়ারির মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হবে। উচ্চশিক্ষার পথে পা বাড়ানো শিক্ষার্থীদের আটকে থাকা এইচএসসির মূল্যায়নের ফলও প্রকাশ করা হবে নতুন বছরে।

অবশ্য আগামী বছর করোনা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এরপরও আটকে থাকা শিক্ষার বিভিন্ন স্তর নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার একগুচ্ছ সিদ্ধান্তের কথা জানাল শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, পরিকল্পনা জানানোয় অনেক উদ্বেগের অবসান হবে। কিন্তু এসব পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। এ নিয়ে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে হবে এবং তদারকি বাড়াতে হবে।

প্রথমত, শিক্ষা নিয়ে একটি পরিকল্পনা পাওয়া গেল। এর ফলে কিছু বিষয়ে অনিশ্চয়তার অবসান হবে। কিন্তু এসব পরিকল্পনা ঠিকভাবে বাস্তবায়ন কতখানি হবে, সেটা নির্ভর করছে সঠিক প্রস্তুতির ওপর।
রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির শুরুতে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা এবং এপ্রিলের শুরুতে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু করোনার কারণে ২০২১ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীরা ৯ মাস ধরে শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা আছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ফলে তাদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনা এখনো চ্যালেঞ্জ।

গতকাল এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, এসব পরীক্ষার্থীর পূর্ণাঙ্গ পাঠ্যসূচি সমাপ্ত করা যায়নি। এ জন্য এখন পাঠ্যসূচি পুনর্বিন্যাস করে পরীক্ষা নেওয়া হবে। পরবর্তী স্তরে যাওয়ার জন্য যেসব বিষয় অত্যাবশ্যকীয়, সেগুলো মাথায় রেখে কাটছাঁট করে এই পাঠ্যসূচি করা হচ্ছে।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এসএসসি ও সমমানের পাঠ্যসূচি ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জানিয়ে দেওয়া হবে। এর ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করিয়ে জুন নাগাদ পরীক্ষাটি নেওয়া হতে পারে। একইভাবে পুনর্বিন্যাস করা পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করিয়ে জুলাই-আগস্টে এই পরীক্ষা নেওয়া হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করছে।

এইচএসসির মূল্যায়ন

এ বছরের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল গত এপ্রিল মাসে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে তা হয়নি। এর মধ্যে গত ৭ অক্টোবর সরকার ঘোষণা দেয়, এ বছর সরাসরি এই পরীক্ষা হবে না। জেএসসি, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার গড় ফলের ভিত্তিতে এইচএসসির ফল ঘোষণা করা হবে। তখন শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, চলতি মাসে এই ফল ঘোষণা করা হবে। কিন্তু এখন আইনি জটিলতার কারণে এ মাসে সেটি আর হচ্ছে না।

ফল তৈরি আছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই অধ্যাদেশ জারি হবে এবং সঙ্গে সঙ্গেই ফল প্রকাশ করা হবে।
দীপু মনি, শিক্ষামন্ত্রী

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইন অনুযায়ী, পরীক্ষার মাধ্যমে এসএসসি ও এইচএসসির সনদ দেওয়া হয়। কিন্তু আইন সংশোধন না করে পরীক্ষা ছাড়া সনদ দিতে গেলে ভবিষ্যতে আইনি ঝামেলা হতে পারে। এ জন্য আইন সংশোধন হওয়া দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকায় আইন করা সম্ভবও নয়। তাই রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে অধ্যাদেশ জারি করে তারপর এই ফল প্রকাশ করা হবে।

শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, ফল তৈরি আছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই অধ্যাদেশ জারি হবে এবং সঙ্গে সঙ্গেই ফল প্রকাশ করা হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মূলত জেএসসি, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল সমন্বয় করে এই ফল প্রকাশ করা হবে। আর বিষয় ভিন্নতা থাকায় জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসির বিষয়গুলোকে ‘ম্যাপিং’ করে বিষয়ভিত্তিক ফল প্রকাশ করা হবে। এ ছাড়া বিভাগ ও বোর্ড পরিবর্তন, মানোন্নয়নসহ অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শক কমিটির সুপারিশে কাজটি হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পরীক্ষা না হওয়ায় এই পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় নেওয়া টাকার মধ্যে যে পরিমাণ টাকা ব্যয় হয়নি, সেই টাকা শিক্ষার্থীদের ফেরত দেওয়া হবে। মূল্যায়নের ফল প্রকাশের পর এ বিষয়ে নির্দেশনা শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ফল নিয়ে কেউ ক্ষুব্ধ হলে বোর্ডে আবেদন করতে পারবে। তবে তাঁর আশা, ফল নিয়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হবে না। তাঁর ভাষ্য, এবার তো সবাই পাস করবে।
এবার এইচএসসি ও সমমানের মোট পরীক্ষার্থী ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পরীক্ষা না হওয়ায় এই পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় নেওয়া টাকার মধ্যে যে পরিমাণ টাকা ব্যয় হয়নি, সেই টাকা শিক্ষার্থীদের ফেরত দেওয়া হবে। মূল্যায়নের ফল প্রকাশের পর এ বিষয়ে নির্দেশনা শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে।

এবার পাঠ্যবই দেওয়া হবে যেভাবে

জানুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৪ কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২২৬ শিক্ষার্থীর জন্য মোট ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ৩৯৪টি বই ছাপছে এনসিটিবি। ২০১০ সালেই প্রতিবছর ১ জানুয়ারি উৎসব করে বই দেওয়া হলেও এবার সেটি হচ্ছে না। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, এবার ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মোট ১২ দিনে বই দেওয়া হবে। একেকটি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভাগ হয়ে তিন দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে বই নেবে। সমাবেশ যাতে না হয়, সে জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে যেগুলোতে শিক্ষার্থী কম, সেগুলোতে এক দিনে এবং যেগুলোতে শিক্ষার্থী তুলনামূলক বেশি, সেগুলোতে তিন দিনে বই দেওয়া হবে।
জাকির হোসেন, প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

কাগজের সংকটের কারণে এবার বই ছাপায় কিছুটা সমস্যার কথা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সব বই জানুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ হয়ে যাবে এবং সব শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে যাবে।

অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন জানিয়েছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে যেগুলোতে শিক্ষার্থী কম, সেগুলোতে এক দিনে এবং যেগুলোতে শিক্ষার্থী তুলনামূলক বেশি, সেগুলোতে তিন দিনে বই দেওয়া হবে। বিদ্যালয়ে ১ জানুয়ারি এই কার্যক্রম শুরু হবে। তবে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসবে না। অভিভাবকেরা এসে বই নিয়ে যাবেন। এর আগে ৩১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঠ্যবই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন।

সনদে জিপিএ থাকবে না

করোনার কারণে গত আগস্টেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার পাশাপাশি চলতি বছরের অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা হবে না। এর ফলে পরীক্ষা ছাড়াই প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী নবম শ্রেণিতে উঠবে। যেহেতু এটি সার্টিফিকেট পরীক্ষা, তাই শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়া হবে। কিন্তু পরীক্ষা না হওয়ায় সনদে কোনো ফল অর্থাৎ জিপিএ উল্লেখ থাকবে না। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, সনদে শুধু উত্তীর্ণ লেখা থাকবে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন স্কুলগুলোতে প্রথম শ্রেণির মতো সব শ্রেণিতেই লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে

রোল প্রথা বাতিল

এত দিন বার্ষিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের রোল নম্বর নির্ধারিত হতো। কিন্তু নতুন বছর থেকে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্রের (আইডি) প্রথা চালু হবে। অর্থাৎ পরিচয়পত্রের নম্বরের ভিত্তিতে শ্রেণি কার্যক্রম চলবে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনই সেটি হচ্ছে না। করোনার কারণে পরীক্ষা না হওয়ায় আগামী বছর আগের শ্রেণির রোল নম্বরই থাকবে। যেমন চতুর্থ শ্রেণিতে যে শিক্ষার্থীর রোল নম্বর এক ছিল, পরীক্ষা ছাড়া পঞ্চম শ্রেণিতে উঠলেও একই থাকবে।

অন্যদিকে মাধ্যমিকে পরীক্ষা না হলেও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ঘাটতি মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এর ভিত্তিতে আগামী বছরের পাঠ্যসূচি নির্ভর করছে। বয়স জটিলতায় ভর্তিতে শিক্ষার্থীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটিও বিবেচনা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত, শিক্ষা নিয়ে একটি পরিকল্পনা পাওয়া গেল। এর ফলে কিছু বিষয়ে অনিশ্চয়তার অবসান হবে। কিন্তু এসব পরিকল্পনা ঠিকভাবে বাস্তবায়ন কতখানি হবে, সেটা নির্ভর করছে সঠিক প্রস্তুতির ওপর। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে, শিক্ষকদের প্রস্তুত করতে হবে। তদারকিও বাড়াতে হবে।