যে কলেজের ছাত্রী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন

কাঁধে ঝোলানো র‍্যাকেট বলে দিচ্ছে, শীত এসে​ গেছে। ক্যাম্পাসেই জমবে ব্যাডমিন্টন খেলা
কাঁধে ঝোলানো র‍্যাকেট বলে দিচ্ছে, শীত এসে​ গেছে। ক্যাম্পাসেই জমবে ব্যাডমিন্টন খেলা

‘প্রথম ক্লাস শুরুর দিন। খুবই উৎসাহ, সারা রাত যেন আর ঘুমই হয় না। সকালে উঠেই তৈরি হলাম। প্রথম দিন কলেজে যাব। নতুন সালোয়ার-কামিজ মা তৈরি করে দিয়েছেন। খুবই সুন্দর প্রিন্ট, একেবারে নতুন বাজারে এসেছে।...কলেজের ভেতরে পা রাখলাম। কত স্বপ্ন, মনে কী উৎসাহ, ক্লাসে যাব। ক্লাসরুমগুলি খুঁজে নিতে হবে। রুটিন জানতে হবে। শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। মনের মাঝে একটা উদ্বেগও কাজ করছে। কলেজজীবনের প্রথম দিন। দারুণ উত্তেজনা, উদ্দীপনা।’
কলেজের প্রথম দিন নিয়ে এভাবেই স্মৃতিরোমন্থন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের স্মরণিকায় এমনটাই লিখেছেন তিনি। পাঠক, চলুন ঘুরে আসি তাঁর কলেজ থেকে।
অগ্রহায়ণের এক সকালে রোদ গায়ে মেখে হাজির হই বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে। শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নন, দেশের প্রথম নারী উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলামসহ অনেক কৃতী নারীই এখানে পড়েছেন। নারীশিক্ষা প্রসারে এই কলেজ ‘বাংলাদেশ’ জন্মের আগেই পথ চলা শুরু করে। ঐতিহ্যবাহী কলেজটি ২০০২ সালে ঢাকা বিভাগে শ্রেষ্ঠ কলেজের মর্যাদা পেয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী কলেজটির প্রধান ফটক

শুরুর কথা
ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে ১৯৪০ সালে পূর্ববঙ্গে তৎকালীন ইডেন ভবনে কলেজটি স্থাপিত হয়। তখন এর নাম ছিল ‘ইডেন স্কুল ও কলেজ’। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে কলেজটি বকশীবাজারে স্থানান্তরিত হয়। সে বছরেই এটি প্রথম মহিলা সরকারি কলেজ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এরপর ইডেন কলেজ, গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, ঢাকা সরকারি মহিলা কলেজ—এমন বেশ কয়েকবার নামবদলের পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বেগম বদরুন্নেসা আহমদের মৃত্যুর পরে তাঁর নামানুসারে কলেজের নামকরণ করা হয় ‘বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ’।

একনজরে
২ দশমিক ১৫ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে কলেজ প্রাঙ্গণ। মাঝখানে এক টুকরো সবুজ মাঠ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে চারটি একাডেমিক ভবন। মিলনায়তনটির নামকরণ করা হয়েছে ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামালের নামে। কলেজে উচ্চমাধ্যমিকসহ ২০টি একাডেমিক বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়। এ ছাড়া এখানে ডিগ্রি পড়ারও সুযোগ রয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে এই কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রীর সংখ্যা ৮ হাজার ৪২৯। আবাসিক এই কলেজের ক্যাম্পাসে দুটি হোস্টেল ভবন, সেখানে ৭০০ ছাত্রীর থাকার ব্যবস্থা আছে। পড়ালেখার সুন্দর পরিবেশ ও নিরাপত্তার জালে বেষ্টিত হয়ে মাঝেমধ্যে নাকি বন্দীই লাগে আবাসিক অনেক ছাত্রীর। সব মিলিয়ে শিক্ষক রয়েছেন ১৪৯ জন। কলেজের অনেক ছাত্রীর অবসর কাটে পাঠাগারে। ইনডোর-আউটডোর গেমসের বিভিন্ন ব্যবস্থাসহ যাতায়াতের জন্য রয়েছে দুটি কলেজ বাস। আবার ক্যানটিনের চা ছাড়া অনেক ছাত্রীর নাকি ক্লাসের ফাঁকে সময়ই কাটে না! আবৃত্তি, নাচ ও গানের চর্চা চলছে কলেজের বিভিন্ন ক্লাবে।

চলছে কলেজের বিএনসিসির সদস্যদের প্রশিক্ষণ। ছবি: লেখক

ইতিহাসের গন্ধ
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি মেনে নিলেও পাকিস্তান আমলে ছাত্রীরা কিছুতেই ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করতে পারছিলেন না। ছাত্রীরা শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার দাবি করলেও কোনোভাবেই রাজি হননি সে সময়ের অধ্যক্ষ। মেয়েরাও দমার পাত্র নন, যে করেই হোক শহীদ মিনার তৈরি করতে হবে। একদিন ইট জোগাড় করে ছাত্রীরা তৈরি করেন শহীদ মিনার। যথারীতি ভেঙেও ফেলে কর্তৃপক্ষ। থামেন না ছাত্রীরা; বরং দ্বিগুণ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আন্দোলনে নামেন। ছাত্রীরা বিভিন্ন ধরনের হয়রানি, শাস্তি ভোগ করেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই কলেজে স্থাপন করেছিলেন শহীদ মিনার।

নিপক-উদ্দীপক
ছাত্রীদের পড়াশোনার মান ও ফলাফলের উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে এই কলেজে গঠন করা হয় নিবিড় পর্যবেক্ষণ কমিটি (নিপক)। এর আওতায় মাসে দুবার ছাত্রীদের বিভিন্ন ব্যক্তিগত সমস্যা ও পারিবারিক অসুবিধা নিয়ে কাউন্সেলিং করেন গাইড টিচার (প্রশিক্ষক)। উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রীদের ১৫টি সেকশনে ভাগ করে পরামর্শ দেন তাঁরা। এ ছাড়া ছাত্রীদের ক্লাসে উপস্থিতি, ফলাফল বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে বছরে দুবার মতবিনিময় সভা করা হয়। এ কর্মসূচির মাধ্যমে ক্লাসে ছাত্রীদের উপস্থিতির হার বাড়ছে এবং ফলাফল আগের তুলনায় ভালো হচ্ছে বলে জানান কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম।

মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম
‘জ্ঞান, শৃঙ্খলা ও একতা’ মূলমন্ত্রে বিশ্বাস করে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি)। নারীকে ঘিরে সামাজিক কুসংস্কার ও বাধাকে জয় করে ১৯৯০ সালে এই কলেজে বিএনসিসি যাত্রা শুরু করে। বিএনসিসি ‘স্বেচ্ছাসেবী দ্বিতীয় সারির সামরিক বাহিনী’ হলেও কলেজের সব ধরনের প্রশাসনিক কাজে নিয়মশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ পায় বলে গর্বের শেষ নেই ক্যাডেট আন্ডার অফিসার মুনিয়া আক্তারের। স্নাতকপড়ুয়া এই শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বড় বড় ন্যাশনাল প্রোগ্রামে আমরা অংশ নিই। খুব ভালো লাগে।’ রমনা রেজিমেন্টের আন্ডারে এই কলেজের প্লাটুনের সদস্য সংখ্যা ৪০।

১৯৭২ সাল থেকে চটপটি ও ফুচকা বিক্রি করেন ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ ‘চটপটি দাদু’

চটপটি দাদু
কলেজ প্রাঙ্গণের ভেতরেই দেখা হলো চটপটি দাদুর সঙ্গে। ১৯৭২ সাল থেকে তিনি এই কলেজে চটপটি ও ফুচকা বিক্রি করেন। নাম আবুল খায়ের হলেও ছাত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষকদের মধ্যেও তিনি ‘চটপটি দাদু’ নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সন্জীদা খাতুন, কাজী রোজীসহ অনেকেই তাঁর হাতে চটপটি খেয়েছেন বলে বেশ গর্ব সদা হাস্যোজ্জ্বল দাদুর।
আলোর তেজ তখন অনেকটাই কমে এসেছে। সারা দিন ঘুরে ঘুরে কিছুটা ক্লান্তিও জমেছে মনের কোণে। এর মধ্যেই কানে আসে, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে, আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে’। তাকিয়ে দেখি কয়েকজন ছাত্রী উদার স্বরে গাইছেন গানটি। ক্লান্তি ঝরে যায়। একরাশ অনুপ্রেরণায় ভর করে কলেজের বাইরে পা রাখি।

মাহ্‌বুবা রহমান

নারীরা নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে
মাহ্বুবা রহমান
অধ্যক্ষ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ
কলেজে স্নাতক পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ ছাত্রীদের সংখ্যা ২০১২ সাল থেকে সন্তোষজনক হারে বাড়ছে। এ জন্য কৃতজ্ঞতা কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের প্রতি। শিক্ষকদের আন্তরিকতা, সহযোগিতা ও অভিনব পাঠদান-পদ্ধতি সাফল্য অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ছাত্রীরাও বেশ নিয়মানুবর্তী। দায়িত্বের শুরু থেকেই আমি ছাত্রীদের মেধা বিকাশে পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ, গান, আবৃত্তির ক্লাব চালুসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছি। এর মাধ্যমে দেশের নারীরা নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে বলে আশা করি।