যেখানে আমিই বাংলাদেশ

সাংস্কৃতিক বিনিময়ের এই সুযোগে পরিচয় হয় নানা দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে লেখক (ডানে) ছবি : সংগৃ হীত
সাংস্কৃতিক বিনিময়ের এই সুযোগে পরিচয় হয় নানা দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে লেখক (ডানে) ছবি : সংগৃ হীত

শুনেছি মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। সব স্বপ্ন হয়তো পূরণ হয় না, কিন্তু একাগ্রতা নিয়ে লেগে থাকলে কিছু কিছু স্বপ্ন নিশ্চয়ই পূরণ হয়। এ কথা এখন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। ভিনদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মে বসে এ রকম একটা নিবন্ধ লেখার স্বপ্নই তো আমি দেখেছি!

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়ি। গত বছরের কথা। ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে হঠাৎই চোখে পড়ল ‘গ্লোবাল ইউগ্র্যাড স্কলারশিপ’–এর বিজ্ঞাপন। এটা মূলত একটা সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রকল্প (কালচারাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম)। প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের শিক্ষার্থীরা এখানে এসে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিস্টারের জন্য পড়ালেখার সুযোগ পান। যাওয়া-আসা, থাকা, খাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি, সব খরচ বহন করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। পাশাপাশি একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের ভাতা দেওয়া হয়।

গ্লোবাল ইউগ্র্যাড বৃত্তির আওতায় প্রতিবছর বিশ্বের নানা দেশ থেকে ১২০ জন শিক্ষার্থীকে ফল সেমিস্টারে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এখানে এসে তারা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পান, পাশাপাশি নিজের দেশের সংস্কৃতিকেও তুলে ধরেন। গ্লোবাল ইউগ্র্যাড শিক্ষার্থীরা পুরো যুক্তরাষ্ট্রের একেক প্রান্তে ছড়িয়ে থাকেন। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ২-৩ জন শিক্ষার্থীকে এই বৃত্তি প্রদান করা হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ২ জন এই প্রকল্পে সুযোগ পেয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা গ্লোবাল ইউগ্র্যাড বৃত্তির জন্য আবেদন করতে পারেন। মূলত যাঁদের একাডেমিক রেজাল্ট ভালো, যাঁরা বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত এবং যাঁদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণ আছে, তাঁদেরই এই বৃত্তির জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়। তবে তার আগে পেরোতে হয় বেশ কয়েকটা ধাপ। প্রাথমিক নির্বাচনের পর টোয়েফল দিতে হয়। মোটামুটি ৪-৫ মাস ধরে চলে চূড়ান্ত মনোনয়নের প্রক্রিয়া। সব শেষে নির্বাচিত শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়ার সুযোগ পান।

গ্লোবাল ইউগ্র্যাড বৃত্তির আওতায় আমি পড়ছি ফ্লোরিডা গালফ কোর্স ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিদ্যা বিভাগে। শুরুতেই আমাকে মুগ্ধ করেছে এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশ থেকে একেবারেই আলাদা। ক্লাসগুলো মূলত আলোচনা–নির্ভর। প্রতিটা কোর্সেই নানা রকম কুইজ, পোস্টার উপস্থাপন, প্রকল্প, কাজের মাধ্যমে শেখার সুযোগ থাকে। অতএব পাঠ্যক্রমের সঙ্গে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। পিছিয়ে পড়ার সুযোগ কম। পড়াশোনা যেমন কঠিন, তেমনি শেখার সুযোগও অনেক বেশি।

প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে ১২০ জন শিক্ষার্থীকে গ্লোবাল ইউগ্র্যাড বৃত্তি দেওয়া হয়

আমাদের দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রছাত্রীরা হেলাফেলার কারণে পিছিয়ে পড়েন। এখানে অধ্যাপকেরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আলাদা করে সময় দেন। ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাই সমস্যাগুলো তাঁদের সঙ্গে আলাপ করতে অসুবিধা হয় না। আমার এক অধ্যাপক যেমন ক্লাসে যেকোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে আমাকে বলেন, ‘তুমি হচ্ছ আমেরিকার বাইরের পৃথিবীর প্রতিনিধি। এ ক্ষেত্রে তোমার মতামত কী? তুমি কীভাবে ব্যাপারটা দেখছ?’ এভাবে আমাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে খুব ভালো লাগে।

ছাত্রাবস্থাতেই এখানে কাজ শুরু করে দিতে হয়। যাকে বলে ‘সার্ভিস লার্নিং অ্যাক্টিভিটি’। বিভিন্ন অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে আমরা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করছি। ফলে গ্রুপ ওয়ার্ক, ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্বের চর্চা হচ্ছে নিয়মিতই।

শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, আরও নানা দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ হচ্ছে। উজবেকিস্তান, চীন, আলবেনিয়াসহ আরও অনেক দেশের কারও কারও সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সব সময় ওদের সামনে আমি বাংলাদেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের সংস্কৃতির কথা বলি। যখনই আমি দেশীয় পোশাক পরে বের হই, ওরা বলে, ‘আই লাভ ইওর আউটফিট। ইটস সো ইউনিক।’ বুঝতে পারি, ওদের কাছে আমিই বাংলাদেশ।

এখানে এসে আমাকে একদম একলা সবকিছু করা শিখতে হয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত—যেখানে সব নিয়মকানুনই অন্য রকম, যার কিছুই আমি জানতাম না, যেখানে আশপাশে কোনো বাঙালি নেই, বাংলা ভাষা নেই, সেখানে শূন্য থেকে শেখা শুরু করতে হয়েছে। তাই এখন আমি জানি, আমার শক্তি আর দুর্বলতার জায়গা কোনটা। হয়তো এখন আমি যেকোনো পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত; যার শুরুটা খুব সহজ ছিল না। তাই আমি মনে করি, নিজেকে জানতে, নতুন করে নিজের ভেতরের শক্তি আবিষ্কার করতে, নিজের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসা খুব জরুরি।

নিজের দেশ, নিজের ভাষার প্রতি অন্য রকম মমতাটা দেশে বসে টের পাওয়া যায় না। তাই নিজেকে জানার জন্য হলেও সুযোগ পেলেই এ রকম প্রকল্পে অংশ নেওয়া উচিত।