মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় যে ছেলে প্রথম হয়েছেন, ছোটবেলা থেকেই যে তিনি পড়ালেখায় একদম ‘সিরিয়াস’, সে কথা কি ঘটা করে বলার প্রয়োজন আছে? সারা দেশ থেকে এ বছর পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ৬৩ হাজার ২৬ জন। এতজনকে পেছনে ফেলে ১ নম্বর আসন দখল করা নিশ্চয়ই চাট্টিখানি কথা নয়।
স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় কখনো দ্বিতীয় হননি ইশমাম। দিনের পড়া দিনে শেষ না হলে তাঁর ঘুম হতো না। ভালো ছাত্ররা নাকি ঘড়ি ধরে, রুটিন করে পড়েন। ইশমামের রুটিনে প্রতিদিন পড়ার জন্য কতটুকু সময় বরাদ্দ থাকত? তাঁর সহজ উত্তর, ‘যতটুকু পড়লে দিনের সব পড়া শেষ হবে, ততটুকুই। সেটা ৩ ঘণ্টা হতে পারে, ১০ ঘণ্টাও হতে পারে।’ কখনো স্কুল ফাঁকি দেননি তিনি। সব ক্লাসেই ছিল তাঁর শতভাগ উপস্থিতি।
দাদার বাড়ি মাদারীপুর জেলায় হলেও এখন খুলনা শহরই মূল ঠিকানা ইশমামদের। বাবা আবদুস সোবহান চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। মা হাবিবুন নাহার একসময় চাকরি করলেও ছেলেদের লেখাপড়ার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন পুরোপুরি গৃহিণী। ইশমামের একমাত্র ছোট ভাই ইশরাক সাদাত অটিজমে আক্রান্ত। ভাইকে দেখেই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। এমবিবিএস শেষ করে নিউরো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার ইচ্ছা তাঁর। নিউরোলজি নিয়ে গবেষণা করার পরিকল্পনা আছে। ভাইয়ের মতো আরও যারা আছে, তাদের সেবা দিতে চান তিনি।
কেমন করে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নটা পেয়ে বসল, বিস্তারিত ইশমামের মুখ থেকেই শুনি। ‘প্রথম থেকে জীবন নিয়ে আমার তেমন পরিকল্পনা ছিল না। ক্লাস এইটে যখন পড়ি, তখন ভাবলাম ইঞ্জিনিয়ার হব। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ভাবনার পরিবর্তন হলো। তখন থেকেই চেয়েছি চিকিৎসক হব।’
বাবা-মায়ের চাকরি সূত্রে ৩৫ দিন বয়সে খুলনায় আসেন ইশমামরা। তবে স্কুলজীবনের শুরু যশোরের ব্যাপটিক চার্জ মিশন স্কুল থেকে। ওই স্কুলে নার্সারি ও কেজি পর্যন্ত পড়েন। পরে কুষ্টিয়ার কলকাকলি বিদ্যালয়ে কাটে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করেছেন কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন খুলনার সেন্ট যোসেফ উচ্চবিদ্যালয়ে। এই স্কুল থেকেই ২০১৬ সালে মাধ্যমিক পাস করেন। মাধ্যমিকে ১২০০ নম্বরের মধ্যে ইশমামের প্রাপ্তি ১১২০। বোর্ডে তাঁর অবস্থান ছিল নবম।
নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছাটা যে সব সময় ছিল, বোঝা যায় উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলে। খুলনা মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে এবার বোর্ডে তাঁর অবস্থান তৃতীয়। মোট ১৩০০ নম্বরের মধ্যে ১২০৪ পেয়েছেন তিনি। অথচ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। জীববিজ্ঞান প্রথম পত্র পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো, পরদিন থেকেই দেখা গেল গুটি গুটি ফোসকা উঠতে শুরু করেছে ইশমামের সারা গায়ে। কঠিন সময়টার কথা বলছিলেন মা হাবিবুন নাহার, ‘ওর অবস্থা দেখে ওর চেয়ে আমি আর ওর বাবা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, ছেলেটা সবগুলো পরীক্ষা দিতে পারবে তো? আমরা ভয় পেলেও ওকে বুঝতে দিইনি। সব সময় উৎসাহ দিয়েছি।’ ছেলে যে মানসিকভাবে বেশ শক্ত, মা-বাবা জানতেন। ঠিকই ধৈর্য ধরে সবগুলো পরীক্ষা দিয়েছেন ইশমাম।
মেডিকেল কলেজের পরীক্ষার প্রস্তুতি খুলনাতেই নিতে হয়েছে। সেখানকার একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলেন। একাগ্রতা ও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহই ছেলেকে সাফল্য এনে দিয়েছে বলে মনে করেন হাবিবুন নাহার। তবে পড়ালেখার জন্য ইশমামকে কখনোই তাঁরা খুব চাপ দেননি। ছোটবেলা থেকে নিজের ইচ্ছামতো তিনি পড়েছেন। পাঠ্যবই, কখনো গল্পের বই। গল্পের বইয়ের প্রতি তাঁর খুব আগ্রহ। রোমাঞ্চ আর রহস্য গল্পই ইশমামের বেশি প্রিয়।
রোমাঞ্চপ্রিয় তরুণটির জীবনে নতুন রোমাঞ্চ শুরু হবে খুব শিগগিরই। মা-বাবা-ভাইকে ছেড়ে একা তিনি কখনো থাকেননি। ছেলে ঢাকায় একা থাকবে, কী খাবে, কীভাবে নিজের দেখভাল করবে, ভেবে দুশ্চিন্তায় আছেন মা। ইশমামকে অবশ্য দুশ্চিন্তার চেয়ে রোমাঞ্চই বেশি টানছে। গান শিখেছেন তিনি। মা আর ইশমাম একসঙ্গে গানের ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। কদিন পর হয়তো ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের আয়োজিত কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁকে মঞ্চে দেখা যাবে। ইশমাম এখন অপেক্ষায় দিন গুনছেন।