>বিবিএ পড়েছি বলেই আমাকে করপোরেট অফিস বা ব্যাংকে চাকরি করতে হবে, অনেকে বিসিএসের পেছনে ছুটছে, তাই আমারও বিসিএস ছাড়া গতি নেই—এ ধরনের প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে করোনাকালের নতুন স্বাভাবিক অবস্থায়। কখনো কখনো একটু ভিন্ন পথে এগিয়েও প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়, অন্যের জন্য কর্মসংস্থান করা যায়। পড়ুন এমন তরুণের কথা—যাঁরা ভিন্নভাবে ভেবেছেন এবং সফল হয়েছেন।
ফয়সাল মোস্তফা তখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে পড়েন। সামনেই চূড়ান্ত পরীক্ষা। কিন্তু পুরকৌশলের এই শিক্ষার্থীর মাথায় অন্য চিন্তা। বন্ধুরা কেউ কেউ বলছিল, ‘বিসিএসের প্রস্তুতি নে।’ উচ্চশিক্ষার জন্য ভিনদেশে যাওয়ার পরিকল্পনাও করছিল সহপাঠীদের অনেকে। আর ফয়সাল ভাবছিলেন, অনলাইনে আয়ের পথঘাট কীভাবে চেনা যায়। ২০১০ সালে অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ পাওয়ার মাধ্যম ওডেস্কে (বর্তমানে আপওয়ার্ক) ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করেন। এখন তিনি ভাইজার এক্স নামে একটি ডিজিটাল বিপণন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে ফয়সালের প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ২৮ জন তরুণ।
শুরুতেই ফয়সাল মোস্তফার কাছে জানতে চাই করোনাকালে কেমন চলছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। তিনি বললেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পরপরই আমরা বেশ কয়েকজন মার্কিন গ্রাহক হারিয়েছি। তখনই আমাদের বিপণন কৌশল বদলাতে হয়েছে। যেসব দেশে করোনার প্রকোপ কম, যেমন কানাডা, বেলজিয়াম, রোমানিয়া, সুইজারল্যান্ড—এমন দেশগুলোকে টার্গেট করে আমরা বিপণন প্রচারণা চালাই। ফলে কিছু নতুন ক্লায়েন্ট পাই। আমার পুরোনো গ্রাহকদের ধরে রাখতেও বিশেষ কিছু অফার দিয়েছি।’ ফয়সাল জানালেন, এই দুর্যোগের সময়েও কাজের চাপের কারণে তাঁকে কর্মী নিয়োগ দিতে হয়েছে। সবাই মিলে এখন ঘরে বসেই দিন-রাত পরিশ্রম করছেন।
পরিশ্রম অবশ্য ফয়সাল মোস্তফার জন্য নতুন নয়। শুরুর দিকে আপওয়ার্ক থেকে কাজ নিয়ে ফিলিপাইনের ফ্রিল্যান্সারদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতেন তিনি। কিন্তু দেখা গেল, আয়ের বেশির ভাগই দিয়ে দিতে হয় পারিশ্রমিক হিসেবে। এদিকে রাতভর জেগে থেকে কাজ করেও লোকের কটুকথা শুনতে হয়। বন্ধুস্বজনেরা বলেন, ‘এবার একটা চাকরি কর।’ কিন্তু ফয়সাল তত দিনে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।
একসময় কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে একদল কর্মী তৈরি করেন ফয়সাল। ফিলিপাইনের ফ্রিল্যান্সারদের ওপর আর নির্ভরশীল থাকতে হয় না। পাশের বাড়ির ছাদে, এক রুম ভাড়া নিয়ে দাঁড় করান নিজের প্রথম অফিস। বাড়তে থাকে কর্মী, ভিনদেশি ক্লায়েন্ট, সেই সঙ্গে আয়ও। শুরুতে প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছিলেন ফাইমাস্ট সফটওয়্যার। পরে কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। ২০১৯ সালে নতুন করে শুরু করেন, নাম দেন ভাইজার এক্স।
এখন বিশ্বব্যাপী ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট, এসইও, অনলাইন মার্কেটিং, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, রেপুটেশন ম্যানেজমেন্টসহ নানা সেবা দিচ্ছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি দেশীয় কিছু প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল মার্কেটিং ও অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিংয়ের কাজও করে ভাইজার এক্স। এ ছাড়া এসইও ভাইজার লিমিটেড নামে ভাইজার এক্সের একটি সহপ্রতিষ্ঠানের নাম নিবন্ধন করিয়েছেন যুক্তরাজ্যে। সেখানেও প্রচুর কাজ আসছে। ফয়সাল মনে করেন, মান ধরে রেখে সময়মতো প্রকল্প শেষ করতে পারলে কাজের অভাব হয় না।
নিজে যেমন ঠেকে শিখেছেন, সেই শিক্ষাটা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। সবাই মিলে এগোতে পারলেই বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সাররা একটা শক্ত অবস্থান পাবেন বলে মনে করেন বুয়েটের এই স্নাতক। তাই অনলাইন মার্কেটপ্লেস ফাইভারে (fiverr.com) বাংলাদেশের যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জন্য ফেসবুকে একটা গ্রুপ পরিচালনা করছেন ফয়সাল মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে আমি ফাইভারে কাজ করতে শুরু করি। তখন থেকেই লক্ষ্য করছিলাম, বাংলাদেশে যাঁরা ফাইভারে কাজ করেন, তাঁদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য কিংবা ছোটখাটো সমস্যা সমাধানের জন্য একটা কমিউনিটি দরকার। সেই চিন্তা থেকেই ফাইভার বাংলাদেশ নামে গ্রুপটা শুরু করি। এখন গ্রুপে সদস্যসংখ্যা ১ লাখ ১২ হাজারের বেশি।’ এই ফেসবুক গ্রুপের সদস্যরা শুধু যে একে অপরকে সাহায্য করেন তা নয়, নিজেদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বও তৈরি হয়ে গেছে। গত বছর গ্রুপের ৭০০ সদস্যকে নিয়ে বিজিএমই ভবনের মিলনায়তনে একটি সভা আয়োজন করা হয়েছিল বলে জানালেন ফয়সাল। সেখানে ফ্রিল্যান্সাররা তাঁদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছেন। করোনার সময়ে ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে বিভিন্ন অধিবেশনের আয়োজন করছেন তাঁরা।
ভবিষ্যতে ভাইজার এক্স–কে নিয়ে আরও অনেক দূরে যাওয়ার ইচ্ছা ফয়সাল মোস্তফার। আলাপের শেষে হেসে বলছিলেন, ‘একসময় যারা আমার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করত, হাসত, এখন তাঁরাও আমাকে নিয়ে গর্ব করে। কাজটা ভালোবেসে স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করে গেছি বলেই হয়তো কখনো ক্লান্ত হইনি।’