বিপুলসংখ্যক শিক্ষক এখনো করোনার টিকা নেননি

ছবি: রয়টার্স

৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ খোলার আগে সব শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে এখন পর্যন্ত প্রাথমিকের প্রায় অর্ধেক শিক্ষক টিকা নেননি। আর মাধ্যমিকের প্রায় ৭ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে কতজন টিকা নিয়েছেন, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) হাতে নেই। তবে মাউশি বলছে, প্রাথমিকভাবে তারা জেনেছে, অধিকাংশ শিক্ষকই টিকা নিয়েছেন। পিছিয়ে আছেন ৪০ বছরের কম বয়সী শিক্ষকেরা।

এদিকে, দেশে করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতি আবারও খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। মৃত্যু ও শনাক্তের হার, দুটোই আবার বাড়ছে। ফলে ঘোষিত সময়ে স্কুল-কলেজ খোলা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি বাড়তে থাকলে ৩০ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হবে না।

এর মধ্যেই করোনা ভাইরাসের কারণে চলতি বছরের এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় কেমব্রিজ পদ্ধতির ‘ও’ এবং ‘এ’ লেবেল পরীক্ষা না নিতে ব্রিটিশ কাউন্সিলকে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গতকাল মঙ্গলবার ব্রিটিশ কাউন্সিলের এ দেশীয় পরিচালককে লেখা এক চিঠিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই নির্দেশ দিয়েছে।

করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সেই হিসেবে একটানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ বুধবার। কাগজপত্রে ১৮ মার্চ থেকে ছুটি বলা হলেও ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকায় সেদিন থেকেই বন্ধ আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পর এত দীর্ঘ সময় ধরে আর কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকেনি।

করোনার বাস্তবতায় দীর্ঘ এই ছুটির কারণে দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর শুধু পড়াশোনাই নয়, তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি উচ্চশিক্ষার শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ে কর্মজীবনে প্রবেশেও পিছিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন পাবলিক ও বার্ষিক পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে।

দূরশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু করা হলেও বাস্তবে তা শহর ও মফস্বল এলাকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য বাড়াচ্ছে। কারণ গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের ক্লাসও খুব একটা কার্যকর হয়নি।

বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দূরশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও বাস্তবে ৬৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই এই ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারেনি। এসব কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমও বাড়তে শুরু করেছে।

করোনার কারণে সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, ২৯ মার্চ পর্যন্ত ছুটি আছে। এরপর ৩০ মার্চ থেকে দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। যদিও গতকাল মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের এই পরিস্থিতি চললে ৩০ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব নয়। এর আগে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও করোনা সংক্রমণ বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার ইঙ্গিত দেন।

* সরকারি প্রাথমিক স্কুলে মোট শিক্ষক ৩ লাখ ৮০ হাজার ৩৭৬ জন, টিকা নিয়েছেন ২ লাখ ১৩ হাজার ৩৭২ জন।* মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরিতে মোট শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী ৭ লাখ ২৯ হাজার ৯৯০ জন, কতজন টিকা নিয়েছেন, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে।

মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত ৩০ মার্চ খোলার সিদ্ধান্ত আছে। তবে তাঁরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেবেন না।

জানা গেছে, ৩০ মার্চ খোলার আগে শিক্ষকদের করোনা ভাইরাসের প্রথম ডোজের টিকা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য করোনার টিকা নেওয়ার নিবন্ধনের জন্য চালু করা ওয়েবসাইটে (সুরক্ষা) শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অগ্রাধিকারভুক্ত করে আলাদা একটি ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’ নামে এই শ্রেণিতে গেলে শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী নামে আলাদা দুটি শ্রেণি রাখা হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট ৩ লাখ ৮০ হাজার ৩৭৬ শিক্ষকের তালিকা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কাছে পাঠিয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সোমবার পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৬০ হাজার ২২৩ জন শিক্ষক নিবন্ধন করেছেন। তাঁদের মধ্যে টিকা নিয়েছেন ২ লাখ ১৩ হাজার ৩৭২ জন।

অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন ৭ লাখ ২৯ হাজার ৯৯০ জন। এর মধ্যে ৪০ বছরের কম বয়সী শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন ২ লাখ ৬৫ হাজার ৪২৬ জন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেছেন, এখন পর্যন্ত কতজন টিকা নিয়েছেন, সেই তথ্যটি দু-এক দিনের মধ্যে তাঁরা চাইবেন।

এ বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক বলেন, কতজন শিক্ষক টিকা নিয়েছেন, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য তাদের কাছে আসেনি। তবে যত দূর জেনেছেন, ৪০ বছরের বেশি বয়সী বেশির ভাগ শিক্ষকই টিকা নিয়েছেন। কিছুটা পিছিয়ে আছেন ৪০ বছরের কম বয়সী শিক্ষকেরা। তাঁরা আশা করছেন, শিগগির সব শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী টিকা নিয়ে নেবেন।

অন্যদিকে ১৭ মে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হল খুলে দেওয়ার আগে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার আবাসিক শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও ‘সুরক্ষা’ ওয়েবসাইটে এখনো শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা চালু করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জানিয়েছে, তাঁরা এখন আবাসিক শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করছে। এরপর টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এই সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অল্প সময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নম্বর পাওয়াসহ কিছু জটিলতার আশঙ্কা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা। আবার অনেক শিক্ষার্থী এখনো জাতীয় পরিচয়পত্রও করেননি। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া শিক্ষার্থীদের আইডি ব্যবহার করে বা অন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।