বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সেখানে থাকে নাচ, গান, কবিতা, কৌতুকসহ নানা আয়োজন। নাচের জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ থাকে। এদিকে এই নির্দিষ্ট সময়ে মন ভরে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী তরিকুল হাসানের। তিনি ভাবলেন, শুধু নাচের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম বানানো যায় না? অনুষদের ছোট ভাই-বোনদের সঙ্গে পরামর্শে বসলেন। সেখান থেকে তরিকুল হাসানের হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠে এফবিএস ড্যান্স স্কোয়াড। তিনি বলছিলেন, ‘অনুষ্ঠান এলেই সবাই নাচের কথা ভাবে। কিন্তু সারা বছর চর্চা করবে, নানা অনুষ্ঠান করবে, এ রকম ক্লাব তো নেই। সেই ভাবনা থেকেই এই ড্যান্স স্কোয়াড গড়ে তুললাম।’ প্রায় একইভাবে গড়ে ওঠে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ড্যান্স ক্লাব—ধ্রুপদি। ধ্রুপদির বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ আল মাসুদ স্মরণ করছিলেন, ‘আমরা একটু গুছিয়ে আরম্ভ করতে চাইছিলাম। তাই ধ্রুপদি আত্মপ্রকাশ করে বিশ্ব নৃত্য দিবসে। এবং সবাইকে জানান দিতে আমরা নিজেদের ক্যাম্পাসেই নাচের প্রতিযোগিতা আয়োজন করি।’
ক্লাবে যুক্ত হওয়ার ঘটনাগুলোও মজার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ড্যান্স ক্লাবের বর্তমান সহসভাপতি আবদুল হামিদের কথাই ধরুন। তিনি এখন যন্ত্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। প্রথম বর্ষে পড়ার সময় একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল ক্যাম্পাসে। সেখানে নাচার দায়িত্ব পড়ে আবদুল হামিদের ঘাড়ে। এই দায়িত্ব বিরাট বিপাকেই ফেলে দিয়েছিল তাঁকে। কারণ, এর আগে কখনো এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। একরকম হাত–পা ছোড়াছুড়ি করতে গিয়েই নাচের চর্চা শুরু হয় তাঁর। ‘ওই নাচ আমার জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। তা না হলে হয়তো একটা প্রতিভা অপ্রকাশিতই থেকে যেত।’ বলেই হা হা করে হাসলেন তিনি।
কুয়েটের ছাত্র আহনাফ বিন আলমগীর, আবদুল্লাহ আল মাসুদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহিদুল ইসলামের ক্লাবে যুক্ত হওয়ার গল্পটাও মোটামুটি এ রকম। কলেজ পর্যন্ত কোনো দিন নাচেননি। কোনো অনুশীলন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নাচের শুরু। এদিক থেকে অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমের ছাত্র জাহিদুলের ঘটনাটা মজার। ক্লাবের বড় ভাইকে একবার বলেছিলেন, তিনিও নাচতে চান। যাচাই-বাছাইয়ের পর তাঁর কপালে এসে পড়ল যুগল নাচ! জীবনের প্রথম নাচ, সেটাও এক বড় আপুর সঙ্গে! তখন আর পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই। অনেক কষ্টে নাচ ওঠালেন এবং কোনো এক কারণবশত অনুষ্ঠানটা শেষ পর্যন্ত বাতিল হলো। তবে তিনি ঢুকে গেলেন ড্যান্স স্কোয়াডে।
মেয়েদের বেলায় অবশ্য ঘটনা ভিন্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনসুরেন্স বিভাগের ছাত্রী পারমিতা দাশের নাচের শখ ছোটবেলা থেকে। ছোট থেকে নাচে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পেয়েছেন মনের মতো প্ল্যাটফর্ম। ব্যস! ঢুকে পড়লেন। কুয়েট পুরকৌশল বিভাগের নুজহাত নাদিয়া নওরীন তো বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নাচ শিখেছেন সেই চতুর্থ শ্রেণি থেকে। নবম শ্রেণিতে ক্ল্যাসিক্যাল নাচের ওপর ডিপ্লোমা করেছেন। নাচ শিখিয়েছেন স্কুলেও। ‘কুয়েটে এসে ধ্রুপদি পাওয়ার চেয়ে আর ভালো ঘটনা কী হতে পারে’, বললেন নুজহাত। বুয়েট ড্যান্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সায়মা আমিনের সঙ্গে অবশ্য কলেজজীবন পর্যন্তও নাচের কোনো সম্পর্ক ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে একদিন একটা মেয়েকে নাচতে দেখে খুব ভালো লাগল। সেখান থেকেই নাচের শুরু।
ক্লাবের সদস্য সংগ্রহের কাজটাও নাকি বেশ মজার। কুয়েটের ছাত্র আহনাফ বিন আলমগীর যেমন বলছিলেন, ‘নাচ শিখে এসেছে, এমন ছেলে আমরা খুব একটা পাই না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর অনেকের আগ্রহ হয়। ধরুন আমরা কয়েকটা স্টেপ শিখিয়ে দিলাম। কিন্তু সেটা অনুকরণ করতে গিয়ে কেউ কেউ এমন এক নতুন নাচের মুদ্রা আবিষ্কার করে ফেলেন, আমরা হেসে খুন হই।’ অনুজেরাও কম যান না। অগ্রজদের প্রথম বর্ষের অডিশনের ভিডিও বের করেন। মেসেঞ্জারে লিংক পাঠিয়ে বার্তা পাঠান, ‘ভাইয়া, আপনিও তো দেখি আগে বেশ ভালো নাচতেন!’ অগ্রজদের এবার মুখ লুকানোর পালা! এভাবেই বন্ধনটা আরও দৃঢ় হয়।
সারা বছর ক্লাবগুলোর কার্যক্রম থাকে। থাকে নাচবিষয়ক কর্মশালা। নিজেরা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। অন্যদের আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। বুয়েট ড্যান্স ক্লাব ভারতের একটি প্রতিযোগিতায় ক্ল্যাসিক্যাল নাচে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যান্স স্কোয়াড অংশ নিয়েছে দেশে অনুষ্ঠিত দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। এসবে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি পর্বের মজার ঘটনাই–বা বাদ যাবে কেন। একবার বুয়েট ড্যান্স ক্লাবের সদস্যরা অংশ নিয়েছিলেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি আয়োজিত প্রতিযোগিতায়। সদস্য সুমিতের কস্টিউম প্রস্তুত। শরীরে জড়িয়ে দেখা গেল মাপজোক ঠিক নেই। বন্ধুরা কেটেকুটে ঠিক করতে গিয়ে আরও অদ্ভুত পোশাক হয়ে গেল!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজনের ঘটনা আবার রোমান্টিকতায় ভরা। ক্লাবে পরিচয় থেকে প্রেম। এর মধ্যে তাঁরা অংশ নেন একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। পরিকল্পনা ছিল, নাচের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিয়ের রীতি তুলে ধরা হবে। বর আর বউয়ের ভূমিকায় কারা থাকবেন, সেটা নিয়ে কারও দ্বিমত ছিল না। খুব আগ্রহের সঙ্গে এই পরিবেশনায় অংশ নিয়েছিলেন দুজন।
এমন আরও কত শত মজার গল্প এই ছেলেমেয়েদের ঝুলিতে। তবে সব মজা-খুনসুটি-ছেলেমানুষির গল্পগুলো মহড়া বা একসঙ্গে আড্ডার সময়ের। মঞ্চে তাঁরা একদম সিরিয়াস!