পছন্দের প্রার্থীদের শিক্ষক নিয়োগ দিতে পরীক্ষার ফলাফলের নম্বরপত্র (ট্যাবুলেশন শিট) কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। এমনকি ট্যাবুলেশন শিটে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর নেই, এমন প্রার্থীও নিয়োগ পেয়েছেন। রাজধানীর হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজে গত কয়েক বছরে অন্তত ১৪ জন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এ রকম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ৭৪ জন শিক্ষক তথ্যপ্রমাণসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে (ডিআইএ) অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করছে ডিআইএ। তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন শিক্ষা পরিদর্শক টুটুল কুমার নাগ, মো. হেমায়েত উদ্দীন, সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক রাকিবুল হাসান, নিরীক্ষা কর্মকর্তা মো. মতিয়ার রহমান ও সুলতান আহমেদ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত কমিটির একজন প্রথম আলোকে বলেন, হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। এ ছাড়া আর্থিক ক্ষেত্রেও কিছু অনিয়ম দেখতে পেয়েছেন তাঁরা। প্রাপ্ত তথ্যগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে তাঁরা তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবেন।
রাজধানীর শান্তিনগরে অবস্থিত হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় ১০ হাজার। মোট ১৫২ জন শিক্ষক এবং ৭২ জন কর্মচারী। অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন আব্দুল জব্বার মিয়া। সাবেক অধ্যক্ষ আবু বকর চৌধুরী সম্প্রতি মারা গেছেন। বর্তমানে কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন অধ্যাপক। এর আগে সভাপতি ছিলেন এস এম বাহালুল মজনুন নামের একজন।
বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ আব্দুল জব্বার মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, অনেক অভিযোগই ভিত্তিহীন। ডিআইএ বিষয়টি তদন্ত করছে। তারা রেকর্ডপত্র নিয়ে গেছে। তাই এখনই তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চান না।
২০১৭ সালের নভেম্বরে কলেজটির হিসাববিজ্ঞান বিভাগে তিনজন প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। কিন্তু নিয়োগ দেওয়া হয় ছয়জনকে। ট্যাবুলেশন শিটে একজনের নম্বর কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। মোট নম্বর ২৩ কেটে করা হয়েছে ৩০। আরেকজন হিসাববিজ্ঞানের এনটিআরসি সনদের বদলে কারিগরির (বিএমএ) সনদ জমা দিয়েছেন।
গণিত বিভাগে ২০১৫ সালের একটি নিয়োগ পরীক্ষার ট্যাবুলেশন শিটে দেখা যায়, প্রভাষক পদে নিয়োগ পাওয়া একজনের প্রাপ্ত মোট নম্বর ছিল ২৫ নম্বর। কাটাছেঁড়া করে মোট নম্বর ৩২ করা হয়েছে।
বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল-কলেজে নানা মাত্রায় দুর্নীতি হয়। এ জন্য তাঁর পরামর্শ হলো সরকারি কর্ম কমিশনের আদলে ‘শিক্ষা সার্ভিস কমিশন’ গঠন করা। এই কমিশনের মাধ্যমে সব নিয়োগ বাস্তবায়ন করা, এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল-কলেজেও বদলির ব্যবস্থা রাখা এবং বিদ্যমান ব্যবস্থা বাদ দিয়ে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো পরিচালনার ব্যবস্থা করা। তাহলে ৮০ শতাংশ দুর্নীতি এমনিতেই কমে যাবে।মাজহারুল হান্নান, শিক্ষক
একই বিভাগে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আরেকটি নিয়োগ পরীক্ষা হয়। বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক, শূন্য পদে দুজন প্রভাষক নিয়োগের কথা ছিল। নিয়োগ কমিটির সুপারিশে প্রথম স্থান অধিকারী মো. মাহফুজার রহমান ও দ্বিতীয় হওয়া নন্দিতা হীরাকে নিয়োগও দেওয়া হয়। তৃতীয় হয়েছিলেন মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া; চতুর্থ রফিকুল ইসলাম। তাঁদের বাদ দিয়ে এমন একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, ট্যাবুলেশন শিটে যাঁর নামের ঘরে প্রাপ্ত নম্বর নেই।
ব্যবস্থাপনা বিভাগে ২০১৮ সালে নিয়োগ পাওয়া একজনের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। ট্যাবুলেশন শিটে কাটাছেঁড়া করে তাঁকে নিয়োগ পরীক্ষায় তৃতীয় বানানো হয়েছে। আরেকজনের যথাযথ শিক্ষক নিবন্ধন সনদ নেই। তিনি নিয়োগ পেয়েছেন ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে। কিন্তু জমা দিয়েছেন কারিগরি নিবন্ধনের প্রত্যয়নপত্র।
অর্থনীতি বিভাগে ২০১৫ নিয়োগ পাওয়া দুজনের ট্যাবুলেশন শিটের নামের ঘরে প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ নেই। আর নম্বর কাটাছেঁড়া করা হয়েছে আরেকজনের। তাঁর মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ৭ কেটে ১০ করা হয়েছে। প্রাণরসায়ন বিভাগে কাজী রায়হান রাফি ও শারমিন সুলতানা যৌথভাবে লিখিত পরীক্ষায় ১৮ নম্বর পেয়েছিলেন। যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তিনি লিখিত পরীক্ষায় মাত্র ৯ নম্বর পেয়েছিলেন। রায়হানের নাম বসানো হয়েছে পঞ্চম স্থানে।
২০১৫ সালে কলেজ পরিচালনা কমিটির সভায় সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) খুলতে সাতজন শিক্ষক নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়। নিয়োগ পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে প্রার্থীদের যে প্যানেল করা হয়, তাতে নাম না থাকা একজনকেও গত অক্টোবরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিবিএ প্রফেশনাল বিভাগে ইংরেজির প্রভাষক নিয়োগের পরীক্ষায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় হওয়া প্রার্থীকে বাদ দিয়ে চতুর্থজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজের বিভিন্ন কাজের জন্য ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে অর্থের নয়ছয় করার অভিযোগও আছে। বিভিন্ন কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম দেখানো হয়েছে। কিন্তু ভাউচারে একই মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। আবার হাতের লেখাও হুবহু মিলে যায়। কোনো কোনো ভাউচারে আবার তারিখ লেখা নেই। অভিযোগকারী শিক্ষকেরা এ রকম কিছু ভাউচারের অনুলিপি অভিযোগপত্রের সঙ্গে জমা দিয়েছেন।
স্বপ্ন পরিবহন (প্রা.) লিমিটেডের প্যাডে একটি ভাউচারে ৪১টি বাস ভাড়ার (বনভোজনের) জন্য বিল ৬ লাখ ১৫ হাজার টাকা। পিকনিক স্পট ভাড়ার (সাড়ে ৩ লাখ টাকা) বিল করা হয়েছে ঢাকা পিকনিক রিসোর্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্যাডে। তাতে থাকা হাতের লেখা স্বপ্ন পরিবহনের প্যাডের হাতের লেখার সঙ্গে মিলে যায়। আবার ঢাকা সাউন্ড সিস্টেমের প্যাডে সাউন্ড সিস্টেমের সরঞ্জাম ও শিল্পীদের সম্মানী (২ লাখ ৬৭ হাজার), শান্তিনগরের অনীক হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট থেকে বিভিন্ন খাবারের জন্য ১৫ হাজার টাকা, মহানগর মাংস বিতান থেকে খাসির মাংস কিনতে ৪ লাখ ৫৯ হাজার টাকা, রাজধানী মোরগ বিতান থেকে মুরগি কিনতে ১ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকা, করিম মনিহারি স্টোর থেকে কেনাকাটায় ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা, হানিফ ডেকোরেটার্সের বিল ৬৮ হাজার ৯৮৪ টাকা দেখানো হয়েছে। এগুলোর প্রতিটি বিল-ভাউচারেই হাতের লেখা একই। এর মধ্যে খিলগাঁওয়ের সিপাহিবাগের হানিফ ডেকোরেটার্স, মাদারটেকের করিম মনিহারি স্টোর, নয়াপল্টনের ঢাকা সাউন্ড সিস্টেম, নন্দীপাড়ার রাজধানী মোরগ বিতান এবং স্বপ্ন পরিবহনের প্যাডে একই মুঠোফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। ফোন দিলে ওই নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এ ছাড়া কুমিল্লা স্টিল থেকে ৫৭ হাজার টাকা দিয়ে তিনটি আলমারি এবং আলী ফার্নিচার স্মার্ট থেকে ৬২৫টি বেঞ্চ রং করতে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ দেখা হয়েছে। কিন্তু দুটি বিলের হাতে লেখায় মিল দেখা যায়। প্রতিষ্ঠানটির ইন্টারনেট বিলেও অসামঞ্জস্য দেখেছে ডিআইএর তদন্ত কমিটি।
জানতে চাইলে প্রায় ৩৮ বছর বেসরকারি কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করা প্রবীণ শিক্ষক নেতা মাজহারুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল-কলেজে নানা মাত্রায় দুর্নীতি হয়। এ জন্য তাঁর পরামর্শ হলো সরকারি কর্ম কমিশনের আদলে ‘শিক্ষা সার্ভিস কমিশন’ গঠন করা। এই কমিশনের মাধ্যমে সব নিয়োগ বাস্তবায়ন করা, এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল-কলেজেও বদলির ব্যবস্থা রাখা এবং বিদ্যমান ব্যবস্থা বাদ দিয়ে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো পরিচালনার ব্যবস্থা করা। তাহলে ৮০ শতাংশ দুর্নীতি এমনিতেই কমে যাবে।