সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক এম তারিক আহসান

নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষাব্যবস্থায় বড় সংস্কারের স্বপ্ন দেখাচ্ছে

দেশের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তনের জন্য তৈরি প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে গতকাল সোমবার। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না। পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম—দুটোই থাকছে। দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা থাকছে না। শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মোশতাক আহমেদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান
ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন

প্রথম আলো: প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বহুল আলোচিত নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন হয়েছে। এখন পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?

এম তারিক আহসান: শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) যৌথ সভায় আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের মধ্য দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা বাস্তবায়নের জন্য একটি আইনগত ভিত্তি পেল। এখন এই রূপরেখার ওপর ভিত্তি করে বিস্তারিত শিক্ষাক্রম অনুমোদন, শিখনসামগ্রী চূড়ান্ত করা, ধাপে ধাপে বিভিন্ন শ্রেণিতে পাইলটিং ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করার কাজ করতে হবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বলা হচ্ছে, নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন হবে। মোটা দাগে সেই পরিবর্তনের বিষয়ে যদি বলতেন?

এম তারিক আহসান: মোটা দাগে পরিবর্তনগুলো হলো দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে ১০টি বিষয় পড়তে হবে, এখনকার মতো মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থাকবে না। বিভাজন হবে একেবারে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে। আর পরীক্ষা ও সনদকেন্দ্রিক পড়াশোনার পরিবর্তে পারদর্শিতাকে গুরুত্ব দিয়ে একেবারে দশম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। শিক্ষার্থীর ওপর চাপ কমানোর জন্য একাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে একাদশ শ্রেণি শেষে একটি পরীক্ষা এবং দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে দ্বাদশ শ্রেণি শেষে আরেক পাবলিক পরীক্ষা হবে। এ ছাড়া পারদর্শিতা অর্জন নিশ্চিত করা এবং মুখস্থনির্ভরতা কমানোর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিখনকালীন বা ধারাবাহিক মূল্যায়নব্যবস্থা চালু হবে। নবম ও দশম শ্রেণিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য কৃষি, সেবা বা শিল্প খাতের একটি পেশার ওপর দক্ষতা অর্জন বাধ্যতামূলক করা এবং দশম শ্রেণি শেষে যেকোনো একটি পেশায় কাজ করার মতো পেশাদারি দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থাও রয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে। সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন-শেখানো কার্যক্রম বিদ্যালয়ের বাইরেও পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে অনুশীলন করা এবং সব শিক্ষার্থীর অভিন্ন মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের জন্য শিক্ষাক্রম রূপরেখার ১০টি বিষয়ের সঙ্গে মাদ্রাসা ও কারিগরি শাখার বিশেষায়িত বিষয়গুলোর যৌক্তিক সমন্বয় সাধন করার কথা রয়েছে এই শিক্ষাক্রমে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, শিক্ষায় অনেক সিদ্ধান্ত হয়, যেমন জাতীয় শিক্ষানীতি, কিন্তু সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় না। ফলে এসবের যথাযথ সুফল পাওয়া যায় না। নতুন শিক্ষাক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হবে বলে মনে করেন কি, হলে সেটি কীভাবে?

এম তারিক আহসান: অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং বেশ কয়েকটি গবেষণা এবং যাচাই-বাছাই থেকে পাওয়া ফলাফলের ভিত্তিতেই এবারের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন পরিকল্পনাটি সুচিন্তিতভাবে করা হয়েছে। এটিও মনে রাখা দরকার, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শিক্ষাব্যবস্থায় বড় সংস্কারের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। যেমন শিক্ষার্থীদের মুখস্থবিদ্যার বদলে বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাদানের দিকে এগিয়ে যাওয়া হবে।

শিক্ষকদেরও প্রচলিত শিখনপদ্ধতির বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াতে হবে। আর বড় সংস্কার করতে গেলে চ্যালেঞ্জ আসবে, বাধা আসবে। এটাই স্বাভাবিক। এ কারণেই শিক্ষাক্রমের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য ২০২৭ সাল পর্যন্ত সময় নেওয়া হচ্ছে, যাতে করে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ধাপে ধাপে শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন কাঠামো ও মানবসম্পদকে প্রস্তুত করে বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়। দেশে এই প্রথম কোনো শিক্ষাক্রম এত দীর্ঘ সময় নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে মনে রাখা দরকার, উন্নত দেশ তথা পৃথিবীর কোনো দেশেই শিক্ষাক্রম শতভাগ বাস্তবায়নের রেকর্ড নেই। এসব বিবেচনায় নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সাফল্য জানতে হলে বেশ খানিকটা সময় দিতেই হবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: শিখনপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের মধ্যে একধরনের দ্বন্দ্বের কথা আমরা জেনে এসেছি, শেষ পর্যন্ত এর কী সমাধান হলো?

এম তারিক আহসান: শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনকৌশল প্রয়োগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই শিখনপ্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের একটি জন্মগত প্রবণতা, যা প্রয়োগ করে শিশু হাঁটতে শেখে, স্কুলে যাওয়ার আগেই মাতৃভাষায় কথা বলতে শেখে।

কাজেই এই প্রাকৃতিক শিখনপ্রক্রিয়া যেকোনো বয়সের শিশুর জন্যই উপযোগী। শিশু সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন সম্ভব না। প্রাথমিক স্তর তাই এই শিখনকে সক্রিয় শিখন বলতে চাচ্ছে। একজন একাডেমিক হিসেবে আমি এটাকে শুধুই নামের পার্থক্য হিসেবে দেখি। আসলে ধারণাগত দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার পরিবর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে বেশি। সে ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকেরা কি প্রস্তুত, না থাকলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?

এম তারিক আহসান: শিক্ষকেরাই এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মুখ্য ভূমিকা পালনকারী। এটি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে। এ জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা করা হয়েছে। যাতে ধাপে ধাপে দেশের বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে প্রস্তুত করা যায়। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ২০২২ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০২৭ সাল পর্যন্ত চলবে। আপনারা ইতিমধ্যে জানেন পাইলটিংয়ের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।

সেখানে শিখন-শেখানো ও মূল্যায়ন উভয় বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা খুবই আশাব্যঞ্জক। কারণ, তাঁদের উৎসাহ ও দক্ষতা দুটোতেই ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে। এরপরও শিক্ষকদের ধারাবাহিকভাবে সশরীর, অনলাইন, দায়িত্ব পালনকালীন এবং মিশ্র উপায়ে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ওপর প্রশিক্ষণপ্রক্রিয়া চলতে থাকবে। এ ছাড়া শিক্ষকদের বিভিন্ন মোবাইল নেটওয়ার্ক ও অনলাইন পোর্টালের সঙ্গে যুক্ত করে ছোট ছোট দলে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক একাডেমিক উন্নয়নের চর্চা করানো হচ্ছে। পরে শূন্য পদে নতুন শিক্ষক নিয়োগের সময় প্রাক্‌-চাকরিকালীন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষকের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিশ্চিত করে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে চাকরিকালীন এবং অব্যাহত পেশাগত উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমেও শিক্ষকদের নিরবচ্ছিন্নভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়া পরিমার্জনের পাশাপাশি সব শিক্ষকের প্রচলিত শিক্ষার কার্যক্রমকে নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখার আলোকে পরিমার্জন ও যুগোপযোগী করে তোলার পদক্ষেপও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার একটি অংশ।