আগামী বছর থেকে প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলটিং) নতুন শিক্ষাক্রম চালুর সিদ্ধান্ত হলেও এখন পর্যন্ত এই শিক্ষাক্রমের আলোকে এসব শ্রেণির বইয়ের পাণ্ডুলিপিই লিখতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কোন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে, সেগুলোও ঠিক হয়নি।
এমনকি নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় দেড় মাস আগেই ইতিবাচক মত দিলেও এখনো রূপরেখাটি চূড়ান্ত করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। দুই মন্ত্রণালয়ের জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) যৌথ সভায় শিক্ষাক্রমের রূপরেখাটির চূড়ান্ত অনুমোদন হওয়ার কথা। এমন পরিস্থিতি বলছে, নতুন শিক্ষাক্রম ‘ভালো’ হলেও আসল কাজ, অর্থাৎ বাস্তবায়ন কাজেই গতি কম। এতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন নিয়ে যে চ্যালেঞ্জের কথা বলা হচ্ছে, সেটিই বাস্তব রূপে সামনে এসেছে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা করে বলছেন, মাত্র দুই মাস পরেই নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হবে। এত কম সময়ে রূপরেখা চূড়ান্ত করে তার আলোকে নতুন বই লেখা হলে তা মানসম্মত না হওয়ার আশঙ্কা আছে। এমন অবস্থায় আগামী বছর যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে যে শ্রেণিতে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে, সেগুলোতে একসঙ্গে পুরো বই না দিয়ে অংশবিশেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষাক্রমের আলোকে যোগ্যতা অর্জন ও শিখনঘণ্টা হিসাব করে তিন বা চার মাসের জন্য ভাগ ভাগ করে বই দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে এনসিটিবি।
অবশ্য এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, পাঠ্যবই প্রণয়নের কাজ চলছে, তাঁরা আশা করছেন, তাড়াতাড়িই বই লেখার কাজ হয়ে যাবে। আর পরীক্ষামূলকভাবে চালুর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্ধারণের কাজও চলছে।
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। আর এসএসসির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষার কথা নেই নতুন শিক্ষাক্রমে। তা–ও শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে এবং এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। নতুন এই শিক্ষাক্রমকে শিক্ষাবিদেরা ভালো বলছেন। যদিও কেউ কেউ বাস্তবায়ন নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জের কথাও বলছেন।
সরকারের সিদ্ধান্ত হলো, আগামী বছর থেকে প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলটিং) নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। এরপর ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি; ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণি; ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। আর উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, নতুন বইয়ে বিষয়বস্তু উপস্থাপনের ধরন পাল্টে সহজে শিখনের বিষয়ে জোর দেওয়া হবে। এতে তথ্য ও তত্ত্বগত বিষয় কমিয়ে ব্যবহারিক শিক্ষায় জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য এখনকার মতো তিনটি পাঠ্যবই পাবে শিক্ষার্থীরা। আর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতেও ছয়টি বই-ই থাকবে। তবে নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে ১০টি বিষয়ে ১০টি বই থাকবে। বর্তমানে এসব শ্রেণিতে ১২ থেকে ১৪টি বই পড়ানো হয়।
শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হলেও প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য পূর্ণাঙ্গভাবেই পাঠ্যবই লিখতে হবে। কিন্তু প্রথম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে বই লেখার কাজ শুরুই হয়নি এখনো। ষষ্ঠ শ্রেণিতে বই লেখার জন্য গাইডলাইন ঠিক হলেও বই লেখার কাজ শুরু হয়নি। ৩০ অক্টোবর থেকে একাধিক দিন সভা করে বই লেখার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। এর মানে বই লিখতে আরও সময় লাগবে। এরপর সেগুলো ছাপার বিষয় আছে।
এর আগে এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেছিলেন, কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ১ বা ২ অক্টোবর নতুন পাঠ্যবই প্রণয়নের কাজ শুরু হবে।
নিয়ম অনুযায়ী, শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুমোদনের পর তার ভিত্তিতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়। তার আলোকে হয় পাঠ্যবই। আগে প্রাথমিকের শিক্ষাক্রমের অনুমোদন দিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এনসিসিসি। আর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষাক্রমের অনুমোদন দিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এনসিসিসি। কিন্তু এবার যেহেতু প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত একসঙ্গে শিক্ষাক্রম হচ্ছে, তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে দুই মন্ত্রণালয়ের এনসিসিসির যৌথ সভায় শিক্ষাক্রমের রূপরেখার অনুমোদন দেওয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই কাজই করতে পারেনি দুই মন্ত্রণালয়। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষাক্রমের রূপরেখার বিষয়ে ইতিবাচক মত দিয়েছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের (ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি) শিক্ষাক্রমের বিষয়ে ২১ অক্টোবর এনসিসিসি পুনর্গঠন করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে এই এনসিসিসির মোট সদস্যসংখ্যা ২১। প্রাথমিকের এনসিসিসিও পুনর্গঠন করা হতে পারে। এরপর নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার চূড়ান্ত অনুমোদন হতে পারে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাক্রমের রূপরেখাটি এনসিসিসিতেও হয়তো অনুমোদন হবে। এরপর বিস্তারিত শিক্ষাক্রম প্রণয়ন শেষে পাঠ্যবই লিখতে হবে। পরে বই ছাপতে হবে। এসব কাজ করে ২০২২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হলেও দুই শ্রেণিতে মানসম্মত বই লেখা যাবে কি না, তা নিয়ে তিনিও সন্দিহান।