প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

তবু পিইসি স্থায়ী করার উদ্যোগ

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) স্থায়ী করতে ‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড’ স্থাপনের উদ্যোগ মন্ত্রণালয়ের।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়
ছবি: সংগৃহীত

নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) বাদ হয়ে যাওয়ার কথা। শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করায় শিক্ষাবিদসহ শিক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোও দীর্ঘদিন ধরে এই পরীক্ষা বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। অথচ এই পরীক্ষা স্থায়ী করতে ‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড’ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। যার অন্যতম কাজ হবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার যাবতীয় কাজ করা।

শিক্ষাবিদেরা বলছেন, এ উদ্যোগ সরকারের নতুন শিক্ষাক্রমের দর্শনের বিরোধী পদক্ষেপ। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার বোঝা কমাতে চান। এ জন্য তিনি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা না রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা স্থায়ী করলে তা শিক্ষার্থীদের ওপর যেমন বাড়তি বোঝা হয়ে থাকবে; তেমনি কোচিং, প্রাইভেট ও নোট-গাইডের ব্যবসা আরও রমরমা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু পরীক্ষা হচ্ছে, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হয়, সে জন্য বোর্ড করতে চাইছেন তাঁরা। কারণ, প্রাথমিক স্তরে পিইসি পরীক্ষাসহ নানান পরীক্ষা আছে। তিনি বলেন, বোর্ড করা দরকার, তাই করতে হচ্ছে। এখন তার সুফল-কুফল নিয়ে লেখালেখি হলে জাতি যদি না চায়, তখন তা পরিবর্তনও হতে পারে।

এই পরীক্ষা স্থায়ী হলে কোচিং, প্রাইভেট ও নোট-গাইডের ব্যবসা আরও রমরমা হবে। নকলের প্রবণতা ও মুখস্থনির্ভরতা বাড়বে।
অধ্যাপক এম তারিক আহসান, সদস্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম, উন্নয়ন, পরিমার্জন কোর কমিটি

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে ২০০৯ সাল থেকে পিইসি পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে সরকার। মাদ্রাসার সমমানের শিক্ষার্থীদের জন্যও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু করা হয়।

শিক্ষাবিদেরা বলে আসছেন, পিইসি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের মুখস্থনির্ভরতা, গাইড বই অনুসরণ ও কোচিং-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছে। শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পিইসি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দেশের ৮৬ শতাংশের বেশি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হয়। আবার ৭৮ শতাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে এই পরীক্ষার জন্য কোচিং ছিল বাধ্যতামূলক।

২০১০ সালে করা জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা আছে, পঞ্চম শ্রেণি শেষে উপজেলা, পৌরসভা বা থানা পর্যায়ে সবার জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা হবে। অর্থাৎ শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণিতে জাতীয়ভাবে পরীক্ষা নেওয়ার কথা নেই। কিন্তু নিজেদের করা শিক্ষানীতিই ঠিকমতো বাস্তবায়ন করেনি সরকার। উপরন্তু এখন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পিইসি পরীক্ষাকে দীর্ঘমেয়াদি করতে ‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড’ স্থাপন করতে যাচ্ছে। বোর্ড গঠন করতে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইন, ২০২১-এর খসড়াও করেছে মন্ত্রণালয়। খসড়ার বিষয়ে মতামত দিতে তা গত রোববার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। খসড়ার বিষয়ে কারও কোনো মতামত বা সুপারিশ থাকলে তা ২৫ নভেম্বরের মধ্যে দিতে বলা হয়েছে।

আইনের খসড়ায় বলা হয়, বোর্ড যেসব কাজ করবে, তার মধ্যে রয়েছে পিইসি পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার যাবতীয় কাজ। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে পরীক্ষাকেন্দ্র ও ভেন্যু অনুমোদন, বিজি প্রেসে প্রশ্নপত্রের চাহিদা পাঠানো ও মুদ্রণ, পরীক্ষা গ্রহণ, মূল্যায়নের ফলাফল প্রকাশ, ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বৃত্তির ফল ঘোষণা, কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের সনদ প্রদান ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষায় সুষ্ঠু মূল্যায়নের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নীতি, পরিকল্পনা, গাইডলাইন প্রণয়ন ইত্যাদি কাজের কথা রয়েছে আইনের খসড়ায়। প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান, পরিচালনা ও উন্নয়নের ক্ষমতা এই বোর্ডের ওপর অর্পিত হবে।

প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় পিইসি ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেটের (জেএসসি) মতো কোনো পরীক্ষা রাখা হয়নি। রূপরেখায় দশম শ্রেণিতে গিয়ে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে যুক্ত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান। তিনি জাতীয় শিক্ষাক্রম, উন্নয়ন, পরিমার্জন কোর কমিটিরও সদস্য। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এক দেশে দুই ধরনের ব্যবস্থা থাকতে পারে না। এতে শিক্ষার আন্তসম্পর্ক বিনষ্ট হবে। বোর্ড করে এই পরীক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার অর্থ হলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অমান্য করা এবং নতুন শিক্ষাক্রমের দর্শনের বিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া। এই পরীক্ষা স্থায়ী হলে কোচিং, প্রাইভেট ও নোট-গাইডের ব্যবসা আরও রমরমা হবে। একই সঙ্গে নকলের প্রবণতা ও মুখস্থনির্ভরতা বাড়বে। তাই এই পদক্ষেপ থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরে আসা উচিত।