করোনার প্রভাব ঠেকাতে শিশুদের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

ইউনিসেফের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সংস্থাটির নতুন এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
ছবি: ইউনিসেফের ওয়েবসাইট

দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সরকারগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে কোটি কোটি শিশু ও তাদের পরিবারের জন্য, বিশেষ করে যাদের জীবন কোভিড-১৯ মহামারি ও অন্যান্য দুর্যোগের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, তাদের মৌলিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষা সেবায় জরুরিভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

ইউনিসেফের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত সংস্থাটির নতুন এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। ‘দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের জন্য সুযোগ পুনরুজ্জীবিত করা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ অঞ্চলের ৬০ কোটি শিশুর মধ্যে সবচেয়ে প্রান্তিক অবস্থানে থাকা শিশুদের ওপর করোনা মহামারি যে অসম প্রভাব ফেলেছে, তা তুলে ধরা হয়েছে।

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরুরি স্বাস্থ্য, টিকাদান, পুষ্টি, সুরক্ষা ও শিক্ষার মতো সেবাগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া না গেলে কোভিড-১৯ মহামারির সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব কয়েক দশক বিরাজ করবে। মানবিক বিপর্যয় এবং খরা, বন্যা ও বায়ুদূষণের মতো জলবায়ু-সম্পর্কিত দুর্যোগগুলো শিশুদের জন্য পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে।

শিশুদের মৌলিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষা সেবায় জরুরিভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির আগে দক্ষিণ এশিয়া ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলোর একটি, যেখানে এ প্রবৃদ্ধিকে আরও জোরদার করতে একটি বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী ছিল এবং এ অঞ্চলে শিশুদের জন্য উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও অর্জিত হচ্ছিল। গত ২৫ বছরে শিশুমৃত্যুর হার অর্ধেকের বেশি কমেছে এবং ২০০০ সাল থেকে খর্বাকৃতির সমস্যায় ভোগা শিশুদের সংখ্যা কমেছে এক-তৃতীয়াংশের বেশি। শিশুদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ক্রমাগত বেড়েছে এবং ১৮ বছর বয়সের আগে মেয়েদের বিয়ের হারও কমে এসেছে। এ অঞ্চলের ৯০ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠী এখন নিরাপদ খাওয়ার পানি পায়।

দক্ষিণ এশিয়ায় ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক জর্জ লারিয়া-আদজেই বলেন, ‘সাম্প্রতিক দশকে শিশু অধিকারের অগ্রগতিতে আমাদের অঞ্চলে যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তা এখন ঝুঁকির মধ্যে। যদি আমরা এখনই পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই, তবে কোভিড-১৯ মহামারির সবচেয়ে খারাপ প্রভাব আগামী কয়েক দশক ধরে অনুভূত হবে। এখন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা সুযোগগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারি এবং এটা নিশ্চিত করতে পারি, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি শিশু কেবল টিকেই থাকবে না, বরং সমৃদ্ধি লাভ করবে।’

শিশুদের জন্য দরকার নিরাপদ ও সুষ্ঠু পরিবেশ।

প্রতিবেদনটি মৌলিক স্বাস্থ্য ও টিকাদান পরিষেবাগুলো সম্পূর্ণরূপে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে সহায়তা করার মতো তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকারগুলো চিহ্নিত করেছে। তবে একই সঙ্গে এ মহামারির কাছ থেকে যে শিক্ষা পাওয়া গেছে এবং নতুন যে সুযোগগুলো তৈরি হয়েছে, তার রূপরেখাও তুলে ধরেছে, যা এখন সব শিশুর উপকারে কাজে লাগানো সম্ভব।

এর মধ্যে রয়েছে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাগুলো, যা আরও ভালোভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য চালু করা উন্নত কোল্ড চেইন ও অক্সিজেন অবকাঠামোর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে। অন্যান্য সুযোগের মধ্যে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে কথোপকথন বৃদ্ধি, যা চাহিদাগুলো শনাক্তকরণে ও আরও পরিষেবার চাহিদা তৈরিতে সহায়তা করছে এবং এ অঞ্চলের গভীর ডিজিটাল বিভাজন দূর করার প্রয়োজনকে তুলে ধরেছে।

শিশুদের অগ্রগতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরি।

ইউনিসেফ বলেছে, শিশুদের অগ্রগতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য জরুরি বিনিয়োগের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ মহামারির ঢেউ মোকাবিলা করার জন্যও এ অঞ্চলের প্রস্তুতি বাড়াতে হবে।

জর্জ লারিয়া-আদজেই বলেন, একের পর এক নতুন ধরনের আবির্ভাব ঘটলেও দক্ষিণ এশিয়ার মাত্র ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণরূপে টিকা দেওয়া হয়েছে। এ কারণে পরিবারগুলো এখনো বিপজ্জনকভাবে অরক্ষিত। বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোকে অবশ্যই কোভিড-১৯ টিকার ন্যায্য ও ন্যায়সংগত প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। মহামারিটি সবার জন্য, শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত কারও জন্যই শেষ হবে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

শিশুদের ওপর মহামারির অসম প্রভাবের বিষয়টি ‘আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের অধিকার, আমাদের কথা’ শিরোনামের একটি যুব বিবৃতিতে পুনর্ব্যক্ত করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের প্রায় ৫০০ তরুণ-তরুণীকে সম্পৃক্ত করা হয় এ ভার্চ্যুয়াল আলোচনায়।

প্রতিবেদনে শিশুদের অগ্রগতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি শিশুর জন্য আরও ভালো একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।

এসব রূপরেখার মধ্যে রয়েছে—

  • শিশু-সংবেদনশীল সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা শিশু ও তাদের পরিবারের জন্য।

  • সশরীর স্কুলে উপস্থিত হয়ে পড়াশোনা চালুর পাশাপাশি পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পদক্ষেপ নেওয়া, এ অঞ্চলের ডিজিটাল বিভাজন দূর করা এবং প্রতিটি শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা।

  • আরও শক্তিশালী সমন্বিত জাতীয় স্বাস্থ্য ও পুষ্টিব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা শিশুদের প্রাণঘাতী কিন্তু চিকিৎসাযোগ্য রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখবে এবং এ অঞ্চলের শিশুদের পুষ্টিসংকট দূর করে।

  • অবহেলা ও শোষণ থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখা এবং সব শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করা।

  • জলবায়ু অভিযোজন এবং শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলোতে স্থিতিস্থাপকতা অর্জনের লক্ষ্যে বর্ধিত বিনিয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া।

করোনায় অন্য প্রায় সব অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় স্কুলগুলো বেশি দিন বন্ধ ছিল।

২০২০ সালে কোভিড-১৯–এর কারণে জরুরি সেবা ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি প্রায় ২ লাখ ২৮ হাজার অতিরিক্ত শিশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এর পাশাপাশি প্রায় ৫৩ লাখ শিশু গুরুত্বপূর্ণ টিকা কার্যক্রম থেকে বাদ পড়ে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ লাখ বেশি। ২০২০ সালে অতিরিক্ত ৩৮ লাখ ৫০ হাজার শিশু শীর্ণকায় হয়ে বেড়ে উঠেছে বা শারীরিক দুর্বলতায় ভুগেছে বলে ধারণা করা হয়।

অন্য প্রায় সব অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় স্কুলগুলো বেশি দিন বন্ধ ছিল। ৪০ কোটির বেশি শিশু ও তাদের শিক্ষকদের এমন একটি অঞ্চলে দূরশিক্ষণ ব্যবস্থায় যেতে বাধ্য করা হয়েছিল, যে অঞ্চলে দূরশিক্ষণ ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় সংযোগ ও যন্ত্র কেনার সক্ষমতা কম। এটা পড়াশোনার সুযোগপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আশঙ্কাজনক অসমতার সৃষ্টি করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র শিশু, মেয়ে ও শারীরিকভাবে অক্ষম শিক্ষার্থীরা অসমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জর্জ লারিয়া-আদজেই বলেন, আজকের সংকট সব শিশুর চাহিদা পূরণ করতে পারে, এমন শক্তিশালী ও অভিযোজিত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার এক অনন্য সুযোগ উপস্থাপন করেছে। কোনো শিশু যাতে পেছনে পড়ে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে ইউনিসেফ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকার, ব্যবসা খাত, সুশীল সমাজ ও শিশুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাবে।