আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপার প্রক্রিয়া শুরু হলেও এ নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। কারণ, এবার প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৩৭ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কম দর দিয়ে কাজ পেতে যাচ্ছেন মুদ্রাকরেরা।
এর ফলে সরকারের টাকা সাশ্রয় হলেও ‘অস্বাভাবিক’ এই কম দর দিয়ে মানসম্মত বই শিক্ষার্থীরা পাবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছে বিনা মূল্যের এসব বই ছাপার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
মুদ্রণকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতিও এই দরে মানসম্মত বই দেওয়া সম্ভব নয় বলে সংশয় প্রকাশ করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছে।
এর আগে ২০১৬ সালে বই ছাপার সময়ও এমন ঘটনা ঘটেছিল। ওই বছর প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপতে বিদেশি প্রকাশনা সংস্থার অংশগ্রহণ ঠেকাতে জোট বেঁধেছিলেন দেশের ২২ মুদ্রাকর ও প্রকাশক। তখন তাঁরা ৩২ থেকে ৪১ শতাংশ কম দরে দরপত্র জমা দিয়ে বই ছাপার কাজ পান। পরে জানুয়ারিতে যখন বই শিক্ষার্থীদের হাতে যায়, তখন দেখা যায় বইয়ের মান খারাপ। এ নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, এবার যখন দরপত্র আহ্বান করা হয়, তখন বাজারে কাগজের দাম অনেক বেশি ছিল। কিন্তু দরপত্র জমা দেওয়ার সময় কাগজের দাম অনেক কমে যায়। এ ছাড়া করোনাভাইরাস মহামারির কারণে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে কোনো কাজ নেই। ফলে তীব্র প্রতিযোগিতায় অনেকে কম দাম দিয়ে দরপত্র জমা দিয়েছে। তবে তাঁরা নির্ধারিত শর্ত অনুযায়ী মান নিশ্চিত হয়ে বই গ্রহণ করবেন।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ২০১০ সাল থেকে বিনা মূল্যে নতুন বই দিয়ে আসছে সরকার। আগামী বছরের মোট সোয়া ৪ কোটি শিক্ষার্থীর জন্য মাধ্যমিক স্তরের ২৫ কোটির কিছু বেশি বই এবং প্রাথমিক স্তরের ১০ কোটি বই ছাপার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এনসিটিবির দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাধ্যমিক স্তরের দরপত্রের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ইতিমধ্যে ২১০টি লটের (বিভিন্ন লটে দরপত্র হয়) সোয়া ১২ কোটি বই ছাপার জন্য দরপত্রে ৪৫টি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। এগুলোকে কাজ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। গত বছরের দরপত্র ও বাজারদর পর্যালোচনা করে এনসিটিবি এসব বই ছাপার জন্য প্রাক্কলিত দর ঠিক করেছিল প্রায় ৩৮২ কোটি টাকা। কিন্তু সর্বনিম্ন মোট দর উঠেছে ২১০ কোটি টাকার কিছু বেশি, যা প্রাক্কলিত দরের চেয়ে গড়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ কম।
অন্যদিকে প্রাথমিক স্তরের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপার কাজের জন্য ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই তিন শ্রেণির জন্য মোট প্রায় সোয়া ৭ কোটি বই ছাপতে প্রাক্কলিত দর ধরা হয়েছিল প্রায় ২১১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ১৩২ কোটি ৪১ লাখ টাকায় এই কাজ পেতে যাচ্ছে। গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানই বেশির ভাগ কাজ পেয়েছে। কেউ কেউ প্রায় ৫০টি লটেও কাজ পেয়েছে। ২৩টি প্রতিষ্ঠান থাকলেও একই ব্যক্তির একাধিক প্রতিষ্ঠান আছে।
>মাধ্যমিকে ২১০টি লটের বই ছাপায় প্রাক্কলিত দর ছিল প্রায় ৩৮২ কোটি টাকা
কিন্তু সর্বনিম্ন মোট দর উঠেছে ২১০ কোটি টাকা
প্রাথমিকে তিনটি শ্রেণির বই ছাপায় প্রাক্কলিত দর ছিল প্রায় ২১১ কোটি ২৪ লাখ টাকা
মোট ১৩২ কোটি ৪১ লাখ টাকায় কাজ
সর্বনিম্ন দরদাতাদের একজন ব্রাইট প্রিন্টিং প্রেসের মালিক এস এম মহসীন। এই প্রতিষ্ঠান ছাড়াও তাঁদের একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এত কম দর দিয়ে কীভাবে মানসম্মত বই দিতে পারবেন জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মূল কারণ হলো গতবারের চেয়ে এবার কাগজের
দাম অনেক কমেছে। এ জন্য কম দর দিতে পেরেছেন। তাঁরা আশা করছেন, এই দরে মানসম্মত বই দিতে পারবেন।
প্রাথমিকে এবারও আন্তর্জাতিক দরপত্রে কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এবার সর্বনিম্ন দরদাতা সবাই দেশীয় মুদ্রণকারী।
এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) মো. ফরহাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কম দর হওয়ায় মানসম্মত বই নিয়ে তাঁরাও যে সংশয়ে নেই, তা নয়। তবে তাঁরা চেষ্টা করবেন মানসম্মত বই আদায়ের জন্য।
এবার অস্বাভাবিক এই কম দামে মানসম্মত বই পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে এবং মানসম্মত বই নিশ্চিত করার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছে মুদ্রণ শিল্প সমিতি।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি এবং পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে বাজারে কাগজের যে দর আছে এবং যে দরে কাজ দেওয়া হচ্ছে, তাতে এনসিটিবির নমুনা মোতাবেক মানসম্মত বই দেওয়া কঠিন হবে। তাই মানসম্মত বইয়ের জন্য এনসিটিবির যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তার সবই নেওয়া উচিত। নইলে শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্মত বই যাবে না।