‘কঠিন’ বিষয় ইংরেজিও যে পাসের হারে বড় ভূমিকা রাখে, এবার তা দেখা গেল উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায়। ইংরেজি বিষয়ে পরীক্ষার্থীরা ভালো করায় পাসের হার গতবারের চেয়ে ৭ শতাংশের বেশি বেড়েছে। অথচ এই ইংরেজিতে খারাপ করার কারণেই গত বছর পাসের হার অনেক কমে গিয়েছিল। এবার ফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে।
আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইংরেজিতে ভালো করার পাশাপাশি কুমিল্লা ও যশোর শিক্ষা বোর্ডের ফল গতবারের চেয়ে এক লাফে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় গড় পাসের হারে প্রভাব পড়েছে। অবশ্য এ দুটি বোর্ডেও পাসের হার বাড়াতে সহায়তা করেছে ইংরেজি।
আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গতকাল বুধবার। এবার গড় পাসের হার ৭১ দশমিক ৮৫ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৬৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গতবার এইচএসসিতে পাসের হার আগের ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল। জিপিএ-৫ গতবারের চেয়ে ১৬ হাজার ২৪৫ জন বেশি। আট বোর্ডে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪১ হাজার ৮০৭ জন (মোট পরীক্ষার্থীর ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ), যা গত বছর ছিল ২৫ হাজার ৫৬২ জন।
পরীক্ষার ফলাফলের মূল সূচক পাসের হার ও জিপিএ-৫ উভয় দিক দিয়েই ভালো করার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, সবার জন্য বাধ্যতামূলক ইংরেজিতে ভালো করায় ফল ঘুরে গেছে। এবার ঢাকা বাদে বাকি সাতটি বোর্ডেই ইংরেজি বিষয়ে গড় পাসের হার ৯১ শতাংশ থেকে ৯৬ শতাংশের বেশি, যা গত বছর ছিল ৬৫ থেকে ৮২ শতাংশ। ঢাকা বোর্ডেও ইংরেজিতে পাসের হার গতবারের চেয়ে বেড়েছে (৭৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ), যা গত বছর ছিল ৭৫ শতাংশের কিছু বেশি। তবে যশোর বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার সবাইকে অবাক করে ৩০ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়েছে। এই বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৫ দশমিক ২২ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৬৫ শতাংশ। কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষার্থীরাও ইংরেজিতে বেশ ভালো করেছেন (৯৬ দশমিক ৪৬) শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৭৩ শতাংশের মতো। এই দুটি বোর্ডে পরীক্ষার্থীদের গড় পাসের হারও অনেক বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার সব বোর্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ (৭৭.৭৪ শতাংশ), যা গত বছর ছিল ৬৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। অথচ এর আগের বছর এই বোর্ডে পাসের হার ছিল ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ।
ফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা হঠাৎ কুমিল্লা বোর্ডের ফল এত ভালো হয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সেখানে উপস্থিত ওই শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুস ছালামকে জবাব দিতে বলেন। তখন চেয়ারম্যান দাবি করেন, আগে ফল খারাপ হওয়ায় তাঁরা জেলায় জেলায় কর্মশালা করে কীভাবে ভালো করা যায়, সেই চেষ্টা করেছেন।
যশোর বোর্ডের গড় পাসের হার ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এই দুটি বোর্ডের ফল গড় পাসের হার বাড়াতে সহায়তা করেছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষার্থীরা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে গেলবারের চেয়ে ভালো করেছেন। সবার জন্য বাধ্যতামূলক এ বিষয়ে ৯০ শতাংশের বেশি পরীক্ষার্থী পাস করেছেন, যা গতবার ছিল প্রায় ৮৩ শতাংশ। এই বোর্ডে পরীক্ষার্থী বেশি হওয়ায় গড় পাসের প্রভাব ফেলেছে।
>সব বোর্ডেই ইংরেজিতে পাস গতবারের চেয়ে বেশি
এবার ৪১,৮০৭ জন জিপিএ-৫
পাসের হার ৭১.৮৫ %
গত বছর ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র বেশ কঠিন হয়েছিল। আর আইসিটি বিষয়ে মানবিকের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক খারাপ করেছিল। এবার ইংরেজির প্রশ্নপত্র ‘কঠিন’ হওয়ার অভিযোগ ছিল না।
ফলাফল মূল্যায়ন করতে গিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, এবারের ভালো ফলের বড় কারণ ইংরেজিতে পরীক্ষার্থীদের ভালো করা। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র কিছুটা সহজ ছিল। আবার গতবার এ বিষয়ে খারাপ করায় এবার পরীক্ষার্থীরা এ বিষয়ে বেশি সতর্ক ছিল।
এবার আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসিতে পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১১ লাখ ২৬ হাজার ১২৬ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৮ লাখ ৯ হাজার ১৪৯ জন। অবশ্য আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে ১০ বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
গতকাল সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফলাফলের তথ্য তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিসহ শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানরা। পরে দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফলের তথ্য তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী। আর বেলা একটায় স্ব স্ব কেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং অনলাইনে ফলাফল একযোগে প্রকাশ করা হয়। ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কলেজগুলোতে চিরাচরিত আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ বছর ফলের সূচকে বেশ কিছু ইতিবাচক লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। পাসের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানের পাশাপাশি মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষায় পাসের হার গত বছরের চেয়ে বেড়েছে।
ইংরেজি বিষয়ে এবার ভালো হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বিশেষজ্ঞ তাঁকে জানিয়েছেন, গতবারের চেয়ে এবার ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র তুলনামূলক সহজ হয়েছে। এটাই ভালো করার বড় কারণ হতে পারে। কারণ, পাঠ্যপুস্তক ও পড়ানোর পদ্ধতিতে তো আর পরিবর্তন হয়ে যায়নি। তবে এখন কোচিং আরও দক্ষতার সঙ্গে হচ্ছে। যেটা শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর কথা সেটা হচ্ছে কোচিংয়ে। এটা দুঃখজনক।
পাঁচ বছর ধরেই এগিয়ে ছাত্রীরা
এবারও এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হারে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীরা এগিয়ে। ফলাফলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুধু এ বছরই নয়, ২০১৫ সাল থেকেই এইচএসসিতে ছাত্রীরা ধারাবাহিকভাবে ছাত্রদের চেয়ে বেশি পাস করছেন। এ বছর ছাত্রীদের পাসের হার ৭৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর ছাত্রদের পাসের হার ৭১ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
তবে ফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্ররা এগিয়ে রয়েছেন। এবার আটটি বোর্ডে মোট জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র ২১ হাজার ৭৬৭ জন। আর ছাত্রী ২০ হাজার ৪০।
ফলে পিছিয়ে চট্টগ্রাম
এইচএসসিতে পাসের হারে সবচেয়ে এগিয়ে কুমিল্লা বোর্ড। আর তলানিতে আছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে এবার পাসের হার ৬২ দশমিক ১৯ শতাংশ। অবশ্য পাঁচ বছর ধরেই এই বোর্ডে পাসের হারে বড় ধরনের কোনো উত্থান-পতন নেই। এই বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মাহবুব হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বোর্ডে বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থীরা ভালো করলেও মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার পরীক্ষার্থীরা খারাপ করেছেন। তাঁরা আইসিটিতে বেশি খারাপ করেছেন। তাই পাসের হার কম।
এবার ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৭১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যশোরে ৭৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ, বরিশালে ৭০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, সিলেটে ৬৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এবং দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার ৭১ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
জিপিএ-৫-এর প্রায় ৮০ শতাংশই বিজ্ঞানের
বিভাগভিত্তিক ফলের তথ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, আট বোর্ডে মোট জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৩ হাজার ১৯২ জনই বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী। এই বিভাগে ৮৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছেন। এ ছাড়া মানবিকে পাসের হার ৬৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ এবং ব্যবসায় শিক্ষায় পাসের হার ৭৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। মানবিকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪ হাজার ৬২৫ জন এবং ব্যবসায় শিক্ষায় পেয়েছেন ৩ হাজার ৯৯০।
বিদেশে পাসের হার ৯৪ শতাংশ
বিদেশের আটটি কেন্দ্রের মাধ্যমে ২৭০ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। পাস করেছেন ২৫৪ জন (৯৪.০৭ শতাংশ)। আর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২৬ জন।
ফলাফলে সন্তুষ্ট না হলে পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আজ বৃহস্পতিবার থেকে ২৪ জুলাইয়ের মধ্যে আবেদন করা যাবে।