করোনাকালে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে এই শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে।
করোনা মহামারির জেরে দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যাহত হয়েছে। সরকারের এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, মহামারিকালে অষ্টম শ্রেণির অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে মধ্যম ও উচ্চমাত্রায় শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে। এই শিখনঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়াসহ বেশ কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) এক গবেষণা প্রতিবেদনে শিখনঘাটতির এই চিত্র উঠে এসেছে।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা প্রায় ১৮ মাস সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান বন্ধ ছিল। তবে বন্ধের ওই সময়ে টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইনে ক্লাস নেওয়াসহ নানাভাবে শিক্ষার্থীদের শেখানোর কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা ছিল। যদিও এসব কার্যক্রমে সব এলাকার সব শিক্ষার্থী সমানভাবে অংশ নিতে পারেনি।
গবেষণা প্রতিবেদনে যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলোর পাশাপাশি বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এই শিখনঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।এম তারিক আহসান, অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের কতটুকু শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা নিরূপণের উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ জন্য বেডুর মাধ্যমে ওই গবেষণা করা হয়।
২০২১ শিক্ষাবর্ষে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে কী মাত্রায় শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা উঠে এসেছে গবেষণায়। এসব শিক্ষার্থী এখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। তারা ২০২৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, ২০২৩ সালেও সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা হবে। এ জন্য ২০২৪ সালের পরীক্ষার্থীদের সামনে রেখে গবেষণাটি করা হয়, যাতে চিহ্নিত ঘাটতি পূরণে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে বেডু। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার গতকাল প্রথম আলোকে জানান, এই প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।
দৈবচয়নপ্রক্রিয়া অনুসরণ করে দেশের প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থী এবং প্রায় ৬ হাজার শিক্ষকের ওপর গবেষণাটি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ওই তিন বিষয়ে অনলাইন পরীক্ষায় অংশ নেয়। এ ছাড়া এ তিন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিখনঘাটতি সম্পর্কে শ্রেণিশিক্ষকের মতামত নেওয়া হয়।
মাত্রা বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের শিখনঘাটতিকে স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চ—এ তিন ধাপে ফেলা হয়েছে। অনলাইন পরীক্ষায় যেসব প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশ বা তার বেশি না পারাকে উচ্চ মাত্রার শিখনঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ৫০ থেকে ৫৯ শতাংশ না পারাকে মধ্যম মাত্রার শিখনঘাটতি হিসেবে ধরা হয়েছে।
গবেষণার তথ্য বলছে, বাংলায় ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যম মাত্রায় ও ২৪ শতাংশের উচ্চ মাত্রায় শিখনঘাটতি রয়েছে। বাংলায় স্বল্প মাত্রায় শিখনঘাটতি থাকা শিক্ষার্থী ২৫ শতাংশ। ইংরেজিতে মধ্যম মাত্রায় শিখনঘাটতি থাকা শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৮ শতাংশ, উচ্চ মাত্রায় ১৮ শতাংশ এবং স্বল্প মাত্রায় শিখনঘাটতি রয়েছে ২০ শতাংশের। গণিতে মধ্যম মাত্রায় শিখনঘাটতি রয়েছে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর, উচ্চ মাত্রার ক্ষেত্রে এই হার ৩৯ শতাংশ এবং স্বল্প মাত্রার ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ।
সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে তিনটি বিষয়েই বেশি শিখনঘাটতি দেখা গেছে। খুলনা ও রংপুর বিভাগের শিখনঘাটতির মাত্রা সবচেয়ে কম। জেলা বিবেচনায় তিনটি বিষয়েই রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত উচ্চ মাত্রায় শিখনঘাটতি শিক্ষার্থী চিহ্নিত হয়েছে।
ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের শিখনঘাটতির ক্ষেত্রে তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। তবে গ্রাম ও শহরভেদে শিখনঘাটতির মাত্রায় বেশ ভিন্নতা রয়েছে। বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে উচ্চ মাত্রার শিখনঘাটতিসম্পন্ন শিক্ষার্থীর হার শহরে সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ এবং গ্রামে সর্বোচ্চ ৪৩ শতাংশ। সমতলের চেয়ে পাহাড়, উপকূল, চর, হাওর অঞ্চলে বেশি শিখনঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
অন্যদিকে সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের চেয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
মধ্যম ও উচ্চ মাত্রার শিখনঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া, টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার, অনলাইন ক্লাস ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়াসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, গবেষণা প্রতিবেদনে যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলোর পাশাপাশি বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এই শিখনঘাটতি পূরণে ব্যবস্থা করতে হবে।