বাবা ফুটপাতে পেঁয়াজি, আলুর চপ বিক্রি করেন। মা তৈরি করেন কাগজের ঠোঙা। গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র সৌরভ তাই স্কুলে যাওয়ার আগে ঠোঙা বানিয়ে সাহায্য করত মাকে আর বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে চপ–পেঁয়াজি ভাজত। ভরা পেট আর উপোস পেটের টানাপোড়েনে বন্ধ হয়নি পড়ালেখা। নিরলস চেষ্টায় এসএসসিতে পেয়েছিল জিপিএ–৫।
প্রথম আলো ট্রাস্টের বৃত্তি পেয়ে সৌরভ চৌহান ঢাকার নটর ডেম কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে পড়েছে উচ্চমাধ্যমিকে। সৌরভ তার সৌরভ ছড়িয়েই যাচ্ছে। প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন দেখা ছেলেটি আবার এইচএসসিতে পেল জিপিএ–৫। নিজেদের বসতভিটা, সহায়–সম্পদ কিছুই নেই। গাইবান্ধায় এক মন্দিরের জায়গায় বসবাস পরিবারটির। ছেলেটির পাশে প্রথম আলো ট্রাস্ট এখনো দাঁড়িয়ে। স্নাতক পর্বেও বৃত্তি পাবে সে। সৌরভের মতো সৌরভ ছড়ানো অদম্য মেধাবীদের আজ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
যখন চারপাশে শুধু চাই, চাই, আরও চাই আর অনেক পেয়েও না পাওয়ার অনুযোগ; অর্থ দিয়ে বিদ্যা (নাকি নম্বর) কেনার প্রতিযোগিতা, তখন সৌরভ, মুক্তা, মেহেদী, শাহিন সুলতানাদের এই জয়ের যাত্রাই আমাদের আগামীর শক্তি, ভবিষ্যতের আলো। যাদের কারও বাবা হয়তো দিনমজুর কিংবা নরসুন্দর। আর তাই তো একবার নয়, অদম্য মেধাবীদের বিদ্যাসফরে বারবার পাশে থাকতে চায় প্রথম আলো ট্রাস্ট। আর চায় সব অদম্য মেধাবী থাকুক এক সুতোয়, এক বন্ধনে। যাতে একে অপরের জন্য বাড়িয়ে দিতে পারে সহযোগিতার হাত। হোক যাত্রী একই তরণির, সহযাত্রী একই তরণির।
এই প্রত্যাশা নিয়েই আজ সকাল ১০টায় ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশে অদম্য মেধাবীদের বৃত্তি প্রদান, সংবর্ধনা ও পুনর্মিলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। অদম্য মেধাবীদের এই বৃত্তি প্রদান এবং অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠনের উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে পাশে আছে ব্র্যাক ব্যাংক। এর আগে প্রথম আলোর নিজস্ব তহবিল, সামিট গ্রুপ, ট্রান্সকম গ্রুপ, আমেরিকান অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহায়তা দিয়েছে। এমনকি এই উদ্যোগে ব্যক্তিগতভাবেও যুক্ত আছেন অনেকে।
প্রথম আলো ট্রাস্ট এ পর্যন্ত ৯৪২ জন অদম্য মেধাবীকে বৃত্তি দিয়েছে। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সহায়তা পেয়েছে ৭১৮ জন ছাত্রছাত্রী। তবে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের সংবাদনাসিকা আর মানবিক মনই পেরেছে এই অদম্য মেধাবীদের খুঁজে বের করতে। প্রথম আলোর পাতায় সেই সব মানবিক জীবনের গল্প পাঠকেরা অনেকেই পড়েছেন। হয়তো সেই মুহূর্তে উজ্জীবিত হয়েছেন। তবে প্রথম আলোর পাতা থেকে তাদের তুলে আবার বইয়ের পাতায় ফিরিয়ে নিয়ে গেছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ওই যে গণসংগীতের কলি—
বলো কী তোমার ক্ষতি
জীবনের অথই নদী
পার হয় তোমাকে ধরে
দুর্বল মানুষ যদি।
তবে বলে রাখা ভালো, অদম্য মেধাবী ছেলেমেয়েগুলো শুধু অর্থনৈতিকভাবেই দুর্বল। তাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প এতটাই অনুপ্রেরণা জোগায় যে প্রতিবছর নিজেদের দুর্বল জীবনী শক্তি বৃদ্ধির জন্য অনেকেই ছুটে যান এই অনুষ্ঠানে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে যান ব্যর্থতা, অপারগতা, অক্ষমতা, অযোগ্যতার মতো নেতিবাচক শব্দগুলো। শিক্ষক থেকে জনপ্রিয় অভিনেত্রী, গবেষক থেকে গায়ক, সাংবাদিক থেকে তারকা খেলোয়াড়—অনেকেই আসেন। আজও আসবেন। তবে আজকের দিনের এই অনুষ্ঠানের তারকা আসলে অদম্য মেধাবীরাই, যারা জীবনলড়াই জিতে একদিন জিতিয়ে দেবে বাংলাদেশকেই।