বর্তমানে চাকরিপ্রার্থীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। সিভিল সার্ভিসের সাধারণ ও কারিগরি/পেশাগত—২ ক্যাটাগরিতে মোট ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। প্রতিটি ক্যাডারের দায়িত্ব ও কাজ, পদায়ন ও প্রশিক্ষণ, বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত প্রকাশ করা হচ্ছে চাকরি-বাকরি পাতায়। আজ প্রথম পর্বে থাকছে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধা। এ বিষয়ে জানাচ্ছেন ৩৫তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা রবিউল আলম লুইপা
ভারতীয় উপমহাদেশের সিভিল সার্ভিসের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী সার্ভিস হলো অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস, যা বর্তমানে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার। এখানে মাঠ প্রশাসন তো বটেই, কেন্দ্রীয় প্রশাসনেও সবচেয়ে বেশি কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তাই বিসিএস প্রার্থীদের অনেকেরই প্রথম পছন্দ থাকে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন, পদোন্নতি, বদলিসহ সব বিষয় পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মাঠ প্রশাসনে সহকারী কমিশনার> সিনিয়র সহকারী কমিশনার/উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা/অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক> জেলা প্রশাসক> বিভাগীয় কমিশনার এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনে সহকারী সচিব> সিনিয়র সহকারী সচিব> উপসচিব> যুগ্ম সচিব> অতিরিক্ত সচিব> সচিব> সিনিয়র সচিব হয়ে থাকেন।
একজন সহকারী কমিশনার (৯ম গ্রেড) জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দক্ষতা অনুসারে তাঁকে সাধারণ শাখা, রাজস্ব শাখা, শিক্ষা ও কল্যাণ শাখা, ট্রেজারি ও স্ট্যাম্প শাখা, নেজারত শাখাসহ ডিসি অফিসের যেকোনো শাখার দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
শাখা অনুযায়ী পদের নাম ও দায়িত্ব নির্ভর করে। যেমন নেজারত শাখায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নেজারত ডেপুটি কালেক্টর বা এনডিসি বলা হয়। একজন এনডিসি জেলায় আসা প্রটোকল ও বিশিষ্ট অতিথিদের ভ্রমণ সূচি অনুযায়ী কার্যক্রম, রাষ্ট্রীয়, সরকারি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা, সার্কিট হাউস, রেস্টহাউস, ডাকবাংলো ইত্যাদি ব্যবস্থাপনাসহ জেলা প্রশাসকের দেওয়া দায়িত্ব পালন করেন।
এ ছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা, নির্বাচন পরিচালনাসহ বিভিন্ন কাজে তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হতে পারে। যোগদানের দুই বছর পর চাকরি স্থায়ী হলে সহকারী কমিশনারদের পর্যায়ক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয় এবং পদের নাম হয় সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ড। একজন এসিল্যান্ড উপজেলা ভূমি অফিসের দপ্তরপ্রধান হিসেবে জমির রেকর্ড, হুকুম দখল, মিউটেশনসহ যাবতীয় ভূমিসংক্রান্ত কাজ তদারক করেন।
পদোন্নতির পর প্রথমে সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে এবং পরবর্তী সময় উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ করতে হয়। একজন ইউএনও উপজেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা পরিষদের নীতি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উপজেলা চেয়ারম্যানকে সহায়তা প্রদান করা, সমন্বিত উপজেলা উন্নয়ন পরিকল্পনাসহ উপজেলা পর্যায়ে সব প্রশাসনিক/উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধান, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৪৪ ধারার অধীন ইউএনও ক্ষমতা প্রয়োগসহ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। একটি জেলায় পাঁচ থেকে ছয়জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) থাকেন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিসি পদমর্যাদাসম্পন্ন) ফৌজদারি মামলা ও আপিল–সংক্রান্ত কাজ, প্যারোল–সংক্রান্ত কাজসহ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (জেলা প্রশাসক) অর্পিত দায়িত্বগুলো পালন করে থাকেন। এ ছাড়া এডিসি (জেনারেল), এডিসি (শিক্ষা), এডিসি (রাজস্ব)–সহ অন্য এডিসিরা নিজস্ব দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
একজন উপসচিব জেলা প্রশাসক (ডিসি), ডিডিএলজি (উপপরিচালক-স্থানীয় সরকার), প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও-জেলা পরিষদ) হিসেবে মাঠ প্রশাসনে অথবা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বা সমপদমর্যাদাসম্পন্ন পদে বিভিন্ন দপ্তরে পদায়ন পেতে পারেন। একজন যুগ্ম সচিব মাঠ প্রশাসনে বিভাগীয় কমিশনার এবং মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য দপ্তরে যুগ্মসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (দ্রষ্টব্য: ঢাকা বিভাগের কমিশনার অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদা)। অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব মন্ত্রণালয় ও সমমর্যাদায় বিভিন্ন দপ্তরে পদায়ন পেয়ে থাকেন।
কাজের বৈচিত্র্য এই ক্যাডারের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। ক্যাডারদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ডেপুটেশনে যাওয়ার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তা কেন্দ্রীয় প্রশাসনে উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি দপ্তর (যেমন-পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, এফডিসি, বিদেশি দূতাবাস), ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার, বিভিন্ন দপ্তরের উপপরিচালক, পরিচালক, মহাপরিচালক, কমিশন/বোর্ডগুলোর সদস্য ও চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই ক্যাডারে নিজ জেলায় পদায়ন করা হয় না। তবে প্রথম পর্যায়ে অন্য বিভাগে পদায়ন হলেও পরবর্তী সময় নিজ বিভাগের কাছাকাছি জেলায় পদায়ন পাওয়া যেতে পারে।
যোগদানের পর প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা অন্যান্য ক্যাডারদের সঙ্গে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (বিপিএটিসি) ৬ মাস মেয়াদি বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ (এফটিসি) গ্রহণ করেন। এরপর চাকরিকালে বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে ৫ মাস মেয়াদি আইন ও প্রশাসন কোর্স, সাভারে ৫২ দিন মেয়াদি ল্যান্ড সার্ভে ট্রেনিং, ক্যান্টনমেন্টে মিলিটারি ওরিয়েন্টেশন ট্রেনিংসহ দেশের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন। এ ছাড়া সরকারি বৃত্তি নিয়ে দেশ-বিদেশে মাস্টার্স এবং পিএইচডি করার সুযোগ রয়েছে।
জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুসারে সব ক্যাডারের কর্মকর্তা ৯ম গ্রেডে ২২,০০০ টাকা মূল বেতনে চাকরি জীবন শুরু করে থাকেন। যোগদানের সময় একটি অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট পাওয়ার পর মূল বেতন হয় ২৩,১০০ টাকা। এ ছাড়া মূল বেতনের নির্দিষ্ট হারে বাড়িভাড়া (জেলা শহরে ৪০ শতাংশ, অন্যান্য বিভাগে ৪৫ শতাংশ, ঢাকা বিভাগে ৫০ শতাংশ), ১ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, সন্তানের জন্য শিক্ষা সহায়ক ভাতা, ঈদ/পূজাতে উৎসব ভাতা, বৈশাখে নববর্ষ ভাতা, সরকারি দায়িত্ব ও যাতায়াতের জন্য টিএ/ডিএ ভাতাসহ সরকারি সব আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন।
এই ক্যাডারে প্রমোশন, আবাসন ও ট্রান্সপোর্ট সুযোগ-সুবিধা ভালো। দায়িত্ব পালনের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তাদের জন্য গেজেটেড অফিসারস ডরমিটরি এবং সরকারি বাসভবনের ব্যবস্থা আছে। কেন্দ্রীয় প্রশাসনে উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে দায়িত্বকালে সময়ে সরকার কর্তৃক প্রণীত অন্যান্য সুযোগ–সুবিধাদি প্রাপ্য হবেন। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব এই ক্যাডারের কর্মকর্তা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক সরাসরি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকার ফলে এই ক্যাডারে থেকে সরাসরি সরকারের নীতিনির্ধারণ, বাস্তবায়ন ও ফিডব্যাক দেখাশোনা করার সুযোগ পাওয়া যায়।
তবে এখানে কাজের ক্ষেত্র ও পরিধি বেশি হওয়ায় অফিস সময়ের আগে ও পরে, এমনকি সরকারি বন্ধের দিনেও বিভিন্ন দায়িত্ব ও প্রটোকলের ব্যস্ততা থাকতে পারে। দায়িত্বের পরিসর বিস্তৃত হওয়ায় ঈদের ছুটিতেও আপনাকে কর্মস্থলে থাকতে হতে পারে। এখানে বিভিন্ন ধরনের চাপ রয়েছে। ফলে ভুলের প্রভাবটাও বেশি। তাই ক্যাডার পছন্দক্রমে রাখার আগে বিস্তারিত জেনে নিন।