দুই বিসিএসে আটকে আছে ৪ হাজার ৬৮৩ ক্যাডার নিয়োগ কার্যক্রম। এই দুই বিসিএস হচ্ছে ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএস। এর মধ্যে ৪১তম বিসিএসের কার্যক্রম ৫ বছর আগে এবং ৪৩তম বিসিএসের কার্যক্রম শুরু হয় প্রায় সাড়ে ৩ বছর আগে। দুই বিসিএসের কার্যক্রম কবে শেষ হবে এবং কবে প্রজ্ঞাপন হবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয় বলেছে, খুব শিগগির (সম্ভব হলে ঈদের আগে) ৪১তম বিসিএসের কার্যক্রম শেষে প্রজ্ঞাপন জারি হবে। আর ৪৩তম বিসিএসের কার্যক্রমও চলমান।
এক বিসিএসে গেল পাঁচ বছর
সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ২০১৯ সালে। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে প্রায় ৪ বছর পর ২০২৩ সালের ৬ আগস্ট এই বিসিএসে ২ হাজার ৫২০ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সুপারিশের ছয় মাসের বেশি পেরিয়ে গেলেও এখনো নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে পড়েছেন নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীরা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, প্রজ্ঞাপন হতে আরও এক মাস লাগতে পারে। পিএসসি সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। এতে আবেদন করেন চার লাখের বেশি প্রার্থী।
মহামারি করোনার কারণে কিছুটা বিলম্বিত হয় এই বিসিএসের নিয়োগ কার্যক্রম। করোনার প্রকোপ কমার পর ২০২১ সালের ১৯ মার্চ প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়া হয়। করোনায় পরীক্ষা কীভাবে হবে, সমস্যা হবে কি না, এটা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও বেশ ভালোভাবে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়া হয় দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে।
এরপর ২০২১ সালের ২ আগস্ট প্রিলিমিনারির ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এতে উত্তীর্ণ হন ২১ হাজার ৫৬ জন। ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ কেন্দ্রে একযোগে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এতে উত্তীর্ণ হন ১৩ হাজার প্রার্থী। ২০২৩ সালের ২৬ জুন শেষ হয় ৪১তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা। ভাইভা শেষে গত বছরের ৬ আগস্ট চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ফলে ২ হাজার ৫২০ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়।
দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়া পরীক্ষার্থীদের ক্ষোভ আর হতাশা দিন দিন বাড়ছে। ৪১তম বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়া ৩০ জন প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। চাকরিতে যোগ দিতে না পারায় নিদারুণ কষ্টে দিন পার করছেন অনেকে। ‘চাকরি তো হয়েছে শুনলাম, কবে যোগদান করছ’ বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের এমন অনেক ব্যঙ্গাত্মক প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন তাঁরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও বিসিএসের গেজেট প্রকাশে দেরি হওয়ায় চাকরির গ্রুপগুলোয় দেখা গেছে নানা আলোচনা।
৪১তম বিসিএসে সুপারিশ পাওয়া এক প্রার্থী বলেন, ‘স্নাতকোত্তর পাস করে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ৪১তম বিসিএসের জন্য আবেদন করি। সাড়ে তিন বছর পর ২০২৩ সালের আগস্টে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। পিএসসি সুপারিশ করার পর প্রায় ছয় মাস পার হয়ে যাচ্ছে, অথচ এখনো আমাদের চূড়ান্ত গেজেট হয়নি। একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়ে এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা কতটা পীড়াদায়ক, তা কেবল ভুক্তভোগীই বুঝতে পারেন। বিসিএসের এই দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া আমাদের মতো উচ্চশিক্ষিত বেকারদের মধ্যে চরম হতাশা সৃষ্টি করে। চাকরিতে যোগ দিয়ে বৃদ্ধ মা-বাবার সেবা করার যে স্বপ্ন আজন্ম বুকে লালন করে আসছি, তা কবে বাস্তবায়ন করতে পারব, সেটা এখনো অনিশ্চিত।’
নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক প্রার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের ছয় মাস চলে গেল। ইতিমধ্যে ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের গেজেট এখনো হচ্ছে না, কবে হবে সেটাও আমরা জানি না। এ নিয়ে উদ্বিগ্নের মধ্যে আছি। কবে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে চাকরিতে যোগ দিতে পারব, কেউ বলছে না।’
৪১তম বিসিএসের নিয়োগ কবে হবে, জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু প্রতিবেদন এখনো এসে পৌঁছায়নি। আরও ১৫ থেকে ২০ দিন লাগবে। ঈদের আগেই তাঁরা যাতে সুখবর পান, সে জন্য কাজ করছি আমরা।’
সাড়ে তিন বছর চলে গেল
গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে ৪৩তম বিসিএসে ২ হাজার ৮০৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। সিদ্ধান্ত অনুসারে ২ হাজার ১৬৩ জনকে ক্যাডার পদে ও ৬৪২ জনকে নন-ক্যাডারে মোট ২ হাজার ৮০৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। আর এই বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বরে। সেই হিসাবে সাড়ে তিন বছর গেলেও আটকে আছে চূড়ান্ত নিয়োগ কার্যক্রম। এই বিসিএসে ২ হাজার ১৬৩ জনকে ক্যাডার পদের সর্বোচ্চ ৮০৩ জনকে সরকারি কলেজের প্রভাষক পদে সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসন ক্যাডারে ৩০০ জন, পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২৫ জন, পুলিশ ক্যাডারে ১০০ জন, কর ক্যাডারে ১০১ জন, তথ্য ক্যাডারে ৪৩ জন ও সহকারী ডেন্টাল সার্জনে ৭৫ জনকে সুপারিশ করা হয়েছে।
নন-ক্যাডারে ৯ম, ১০ম ও ১২তম গ্রেডে মোট ৬৪২ জনকে বিভিন্ন পদে সুপারিশ করা হয়েছে। নন-ক্যাডারে ৬৪২ জনের সর্বোচ্চ ২৭৪ জনকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে সুপারিশ করা হয়েছে।
গত বছরের বছরের ২০ আগস্ট ৪৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এতে উত্তীর্ণ হন ৯ হাজার ৮৪১ জন। জুলাইয়ে পিএসসি এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করেছিল। ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ কেন্দ্রে ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফলাফল প্রকাশিত হয়। এতে উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ২২৯ প্রার্থী। ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৮১৪ কর্মকর্তা নেওয়া হবে। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারে ৩০০ জন, পুলিশ ক্যাডারে ১০০, পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২৫, শিক্ষা ক্যাডারে ৮৪৩, অডিটে ৩৫, তথ্যে ২২, ট্যাক্সে ১৯, কাস্টমসে ১৪ ও সমবায়ে ১৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ ছিল।
এই বিসিএসের কার্যক্রমের গতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরপর দুটি বিসিএসের কাজ চলে আসার কারণে আমরা কিছুটা বিপাকে পড়েছি। নির্দিষ্ট জনবল দিয়েই কাজ করছি। ৪১তম বিসিএসের কার্যক্রম শেষের দিকে। তবে ৪৩তম বিসিএসের কার্যক্রমও চলমান। প্রার্থীদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আগে ৪১তম শেষ হোক, পরে ৪৩তমদের কাজ শেষ করা হবে।’