মো. আনিসুর রহমানের বেড়ে ওঠা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ছোট প্রতিষ্ঠানে বেসরকারি চাকরি করতেন। মা গৃহিণী। থাকতেন পল্লবী এলাকার একটি টিনশেড বাসায়। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে আনিসুর সবার বড়। আনিসুরসহ চার ভাই পড়তেন পল্লবী মাজেদুল ইসলাম মডেল হাইস্কুলে। একবার স্কুলে প্রথম সাময়িক পরীক্ষার আগে সবার বকেয়া বেতন ও পরীক্ষা ফি ৩ হাজার ৬০০ টাকা দিতে না পারায় চার ভাইয়ের কাউকেই পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয়নি।
প্রধান শিক্ষকের কাছে পরীক্ষায় বসার আবেদন করেও সম্মতি পাননি তাঁরা। বাধ্য হয়েই স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। বন্ধ হয়ে যায় চার ভাইয়ের লেখাপড়া। প্রতিবেশীরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে অন্য কিছু করার কথা বলেন। কিন্তু আনিসুরের মা তা হতে দেননি। শুরু হয় আনিসুর ও তাঁর মায়ের জীবনসংগ্রাম। ভাঙারি ব্যবসায়ী এক চাচার কাছ থেকে টাকা ধরে করে পরবর্তী সময় আনিসুর ভর্তি হন রূপনগর ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলে। সেখানে এক শিক্ষকের সহায়তায় নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যান। টিউশনি করে অন্য ভাইদের আবার পড়াশোনা শুরু করার ব্যবস্থা করেন। এই চার ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই মো. আনিসুর রহমান ও ছোট ভাই মো. রাফসান রুবেল এবার একই সঙ্গে ৪১তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। মো. আনিসুর রহমান প্রশাসন ক্যাডারে (মেধাক্রম ২৪) ও মো. রাফসান রুবেল কৃষি বিপণন ক্যাডারে (মেধাক্রম ৮) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
স্কুল থেকে ঝরে পড়ার সেই দিনের কথা মনে হলে এখনো চোখ টলমল করে ওঠে আনিসুরের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকার অভাবে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি না পাওয়ায় স্কুলের গেট দিয়ে আমরা চার ভাই পরীক্ষা না দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, সেই গেট দিয়েই আমাদের সহপাঠীরা পরীক্ষার হলে যাচ্ছিল। দু-একজন জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাস, পরীক্ষার আর কিছুক্ষণ বাকি আছে।” আমি কিছু না বলে ছোট ভাইদের সঙ্গে নিয়ে অন্য রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। সে পথটা মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ পথ। কাঁদতে কাঁদতে বাসায় যাওয়ামাত্রই মা আমাদের দেখে তিনিও কান্না শুরু করেন। আমাদের অসময়ে বাড়িতে দেখেই মা বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর সন্তানেরা টাকার অভাবে পরীক্ষা দিতে পারেনি। সেদিন আমার মায়ের কান্নার দৃশ্য, আমার ছোট ভাইদের কান্নার দৃশ্য আমার কাছে আজও পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টের দৃশ্য। সেই দৃশ্য আমি আজও ভুলিনি আর কখনো ভুলবও না। সেই কান্নার দৃশ্য আমাকে আমার অতীত মনে করিয়ে দেয় এবং আমাকে আরও বেশি পরিশ্রম করার শক্তি জোগায়।’
মিরপুরের রূপনগর ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রধান শিক্ষক সুফিয়া হোসেনের সহযোগিতায় আনিসুরের জীবনযুদ্ধ কিছুটা সহজ হয়। আনিসুর রহমান বলেন, ‘সুফিয়া হোসেন ম্যাডাম স্কুলে বিনা বেতনে পড়াতেন। ম্যাডাম একদিন ডেকে বললেন, “তোমাকে আরও পড়াশোনা করতে হবে। তুমি আমার বাসায় এসে পড়বে।” কিন্তু আমার মা-বাবার তো টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই জানালে ম্যাডাম বললেন, “আমি টাকার জন্য পড়াই না, আসতে বলেছি আসবে।” পরদিন ম্যাডামের বাসায় গিয়ে শুরু হলো ইংরেজি পড়া। ম্যাডাম তো টাকা নিতেন-ই না, উল্টো আমাকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা দিতেন। আমি শুধু একটা কথাই ভাবতাম, মানুষ এত ভালো হয় কী করে? আমি যতটুকু ইংরেজি শিখেছি, তা ম্যাডামের কাছ থেকেই শিখেছি। পরবর্তী সময় ইংরেজি পড়িয়ে নিজের পড়াশোনা, ছোট ভাইবোন এবং পরিবারের খরচ চালিয়েছি। ম্যাডামের সেই ঋণ হয়তো কখনো শোধ করতে পারব না, তবে চেষ্টা করি টাকার অভাবে যাদের পড়াশোনা থমকে যায়, তাদের সাহায্য করতে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগ থেকে পাস করা আনিসুর রহমানের ৪১তম বিসিএস পরীক্ষা ছিল তৃতীয় বিসিএস। এর আগে ৩৮ ও ৪০তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যোগদান করেননি। ২০১৯ সাল থেকে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনে (পিকেএসএফ) কর্মরত আছেন। চাকরি করার পাশাপাশি বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়েছেন।
বিসিএসের প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা—তিনটি ধাপের মধ্যে লিখিত ধাপ সবচেয়ে কঠিন মনে হয় বলে জানান আনিসুর। তিনি বলেন, ‘লিখিত পরীক্ষায় পাঁচ দিনে মোট ২১ ঘণ্টা লিখতে হয়। আমার মতো যাঁরা চাকরি করে, বিসিএস পরীক্ষা দেন, তাঁদের জন্য এটা অনেক কঠিন। কারণ, চাকরি করলে শুধু পরীক্ষার দিনই ছুটি পাওয়া যায়, পরীক্ষার আগে-পিছে পাওয়া যায় না। তাই টানা পরীক্ষা দিতে গিয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমিও একটি পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়েছিলাম।’
আনিসুরের ছোট ভাই মো. রাফসান রুবেল শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অর্থনীতি বিষয়ে বিএসসি করার পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএতে। এখনো এমবিএ করছেন। ৪১তম বিসিএসে প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই সফলতা পেয়েছেন। কৃষি বিপণন ক্যাডারে মেধাতালিকায় অষ্টম হয়েছেন তিনি। বর্তমানে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত।
মো. আনিসুর রহমানের মতো একজন বড় ভাই পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন ছোট ভাই রাফসান রুবেল। তিনি বলেন, ‘পুরো যুদ্ধটাই আসলে বড় ভাইয়ের একার। ভাই আমাদের পরিবারের ফাদার ফিগার। নিজে পড়াশোনা করার পাশাপাশি আমাদের সবার দায়িত্ব নিয়ে মানুষ করেছেন। বড় ভাইদের কেন মাথার ছায়া বলা হয়, সেটা আমি আমার জীবনে প্রমাণ পেয়েছি।’