প্রশাসনে ৬৩তম মান্না

‘ফল দেখে চিৎকার করে মায়ের পা ধরে বসে ছিলাম’

এস এম মান্না
ছবি: সংগৃহীত

৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার প্রথম পছন্দ ছিল এস এম মান্নার। ফলাফলেও নিজের পছন্দের ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। প্রশাসন ক্যাডারে তাঁর মেধাক্রম ৬৩তম। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ২০১৮ সালে স্নাতক পাস করেন তিনি।

শরীয়তপুরের ইদিলপুর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, ঢাকা থেকে এইচএসসি পাস করেন এস এম মান্না। এসএসসি এবং এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ার। তাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও ভর্তি হননি।

এরপর শতভাগ বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিতে। এস এম মান্না বলেন, ‘স্কুলজীবনে ভালো ছাত্র থাকায় আমার প্রতি সবার অনেক আশা ছিল। কিন্তু এইচএসসিতে ভালো ফলের পরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হতে পারিনি দেখে সবাই হতাশ হয়েছে এবং অনেক কটুকথাও শুনতে হয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, জীবনে সব সময় দ্বিতীয় সুযোগ থাকে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত মানুষের হাতে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ রয়েছে।’

৪১তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা খুব ভালো দিয়েছিলেন মান্না। তিনি বলেন, ‘লিখিত পরীক্ষা খুব ভালো দেওয়ায় আশাবাদী ছিলাম ক্যাডার হব। লিখিত পরীক্ষায় ৫৯০ নম্বরের কাছাকাছি নম্বর পাব বলে আশা রাখি। এরপর ভাইভাও ভালো হয়েছিল।’

এস এম মান্নার যেদিন মৌখিক পরীক্ষা ছিল সেদিন সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি) গিয়ে দেখেন আশপাশের সবাই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থী। সেদিন ভাইভা প্রার্থীদের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা প্রার্থী তিনি শুধু একাই ছিলেন। মৌখিক পরীক্ষার ক্রমিক নম্বরে প্রথমে তাঁর রোল ছিল। ফলে সবার আগে তাঁর ডাক পড়ে। প্রায় ২৫ মিনিটের মতো ভাইভা হয়। সব মিলে তাঁকে ৩০টি প্রশ্ন করা হয়েছিল।

এস এম মান্না

৪০তম বিসিএসে প্রথম পছন্দ ছিল পুলিশ ক্যাডার। কিন্তু ৪১তম বিসিএসে প্রথম পছন্দ দিয়েছিলেন প্রশাসন ক্যাডার। দুই বিসিএসে দুই রকম পছন্দক্রম কেন, প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘স্নাতক শেষ হতে না হতেই ৪০তম বিসিএসের আবেদন শুরু হয়ে যায়। তাই আবেদনের আগে সব ক্যাডার সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা নিতে পারিনি। পুলিশের পোশাকের প্রতি একটা আকর্ষণ থাকায় প্রথম পছন্দ দিয়েছিলাম। কিন্তু ৪১তম বিসিএসে আবেদনের সময় সব ক্যাডার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাই। প্রশাসন ক্যাডারদের বৈচিত্র্যময় চাকরিজীবন, সামাজিক মর্যাদা ও উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ থাকায় প্রশাসন ক্যাডার প্রথম পছন্দে রেখেছি।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারি চাকরিতে চাকরিপ্রার্থীরা কম আসে, আপনি আসার পেছনে কোনো কারণ আছে কি না? বিসিএস ভাইভা বোর্ডে এমন প্রশ্নের জবাবে এস এম মান্না বলেছিলেন, ‘প্রথমে ইচ্ছে ছিল বিদেশ যাওয়ার। কিন্তু পরে যখন দেখলাম বিসিএসে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং এখানে চাকরির মাধ্যমে আমার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে মানুষের সেবা করতে পারব, তখন আমি দেশে থেকে মানুষের সেবা করার সিদ্ধান্ত নিই। এ জন্য বিসিএস দেওয়ার পরিকল্পনা করি। সৎ থেকে মানুষের সেবা করতে চাই এবং দেশের জন্য কাজ করে যেতে চাই।’

এস এম মান্না প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৮ সালের অক্টোবরে আমার স্নাতক পরীক্ষা শেষ হয়। সে মাসেই দুর্ঘটনায় আমার বাবার পা ভেঙে যায়। বাবার অপারেশন শেষে তাঁকে বাড়িতে রেখে ঢাকায় এসে শুরু হয় আমার বিসিএস জার্নি। প্রথম বিসিএসেই প্রিলি, লিখিত, ভাইভা পাস করলেও ক্যাডার হতে পারিনি। কোভিডের পুরো সময়টা বাড়িতে ছিলাম। পরে ঢাকা এসে সারা দিন লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করেছি এবং ৪১তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার জন্য নিজেকে তৈরি করেছি। এরপর ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষাও দিয়েছি।’

৪১তম মান্নার দ্বিতীয় বিসিএস। ৪০তম প্রথম বিসিএস ছিল। সেখানে প্রিলিমিনারি লিখিত ও ভাইভা পাস করে নন-ক্যাডারের তালিকায় রয়েছেন। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের অধীন প্রতিরক্ষা অডিট অধিদপ্তরে অডিটর হিসেবে অল্প কিছুদিন চাকরি করেছেন। বর্তমানে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরে সহকারী প্রোগ্রামার (৯ম গ্রেড) হিসেবে কর্মরত আছেন।

এস এম মান্না বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর প্রতিবেদনের পর নিশ্চিত ছিলাম, সেদিনই ফল প্রকাশিত হবে। বিকেল পর্যন্ত অফিসে বসে ছিলাম। বিকেল সাড়ে পাঁচটার পরে বের হয়ে দেখি মোবাইলে চার্জ নেই। বাসায় আসতে আসতে রাত সাড়ে আটটা বেজে যায়। ততক্ষণে ফল প্রকাশিত হয়েছে। মোবাইল চার্জে দিয়ে রেজাল্ট শিট ডাউনলোড করে নিচের দিক থেকে নিজের রোল খুঁজতে থাকি। প্রায় পাঁচ মিনিট পর নিজের রোল দেখে চিৎকার করে মায়ের পা ধরে বসে ছিলাম। মা আমার চিৎকার শুনে অনেক ভয় পেয়ে যায়। পরে মাকে বলি, মা আমি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে গেছি। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন।’

যাঁরা বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁদের উদ্দেশে এস এম মান্না বলেন, ‘সঠিক গাইডলাইন অনুসরণ করে ধৈর্য ধরে লেগে থাকলে সফল হওয়া সম্ভব। সর্বোচ্চ চেষ্টা এবং ভাগ্য ভালো হলে কেউ নিরাশ হবে না বলে আমার বিশ্বাস। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রাইভেট, পাবলিক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বড় ইস্যু নয়, তার প্রমাণ আমি নিজেই। নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারলে সফলতা অবশ্যই আসবে।’