মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডান। বাংলাদেশের নারী পোশাককর্মীদের জন্য নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে দেশটি। বাংলাদেশ থেকে প্রতি সপ্তাহে দেশটিতে ৩০০ জন করে পোশাক খাতের কর্মী যাচ্ছেন। বছরে গড়ে সংখ্যাটি দাঁড়ায় প্রায় ১৫ হাজার। আর যাওয়ার খরচ নামমাত্র। ১ হাজার ২০০ টাকা! বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসেল) ব্যবস্থাপনায় দেশটিতে যেতে পারছেন দক্ষ নারী ও পুরুষ কর্মীরা। গত ৩০ জুন পর্যন্ত বোয়েসেলের মাধ্যমে ৮২ হাজার ৬৬৮ জন কর্মী জর্ডানে গেছেন। এর মধ্যে ৮১ হাজার ৭৬৬ জন নারী এবং ৯০২ জন পুরুষ কর্মী। তাঁরা জর্ডানের প্রায় ৪০টি পোশাক কারখানায় কর্মরত আছেন।
বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বিল্লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জর্ডানে যেসব বাংলাদেশি কাজ করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত। ২০১০ সাল থেকে জর্ডানে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো শুরু হয়। গত অর্থবছরে জর্ডানের ৪০টি কোম্পানিতে প্রায় ১৫ হাজার দক্ষ নারী পোশাককর্মী পাঠানো হয়েছে। ভবিষ্যতে দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মীদের সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পাবে।
সাধারণত কম দক্ষতা ও উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পদে কর্মী নেওয়া হয়। কম দক্ষতার পদগুলোর মধ্যে রয়েছে মেশিন অপারেটর, কোয়ালিটি কন্ট্রোলার ও চেকার। এই তিন পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন লাগে না। শুধু কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। উচ্চ দক্ষতার পদগুলো হলো সুপারভাইজার, লাইন ম্যানেজার, মেকানিক, প্রোডাকশন সুপারভাইজার ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার। এসব পদে ন্যূনতম যোগ্যতা এসএসসি পাস থেকে স্নাতক–স্নাতকোত্তর পর্যন্ত। এ ছাড়া চাহিদামতো কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।
জর্ডানের ন্যূনতম মজুরি বাংলাদেশের কারখানাগুলোর ন্যূনতম মজুরির প্রায় দ্বিগুণ। বোয়েসেলের উপমহাব্যবস্থাপক নূর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কম দক্ষতার পদগুলোয় মাসিক ন্যূনতম বেতন ১৭ থেকে ২৫ হাজার টাকা। ওভারটাইমের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসা ফ্রি। কর্মীদের আসা–যাওয়ার বিমানভাড়াও নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান দেয়। কর্মীদের জন্য বিমা–সুবিধাও রয়েছে। উচ্চ দক্ষতার পদগুলোয় বেতন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানভেদে আলোচনা সাপেক্ষে বেতন নির্ধারণ করা হয়।
জর্ডানের ক্ল্যাসিক ফ্যাশনে দীর্ঘদিন প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন মো. রফিকুল ইসলাম। বর্তমানে সেখানকার আরেকটি প্রতিষ্ঠান নিডেল ক্রাফটে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সাধারণ পোশাককর্মীদের চাকরির শুরুতেই বেতন ১৭ হাজার টাকা। এ ছাড়া ওভারটাইমসহ মাসে ২৭ থেকে ২৮ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন অনেকে। থাকা ও খাওয়া কোম্পানি দেয়, তাই কর্মীরা যা বেতন পান, চাইলে পুরোটা সঞ্চয় করতে পারেন।
বোয়েসেলের উপমহাব্যবস্থাপক নূর আহমেদ বলেন, নির্বাচিত কর্মীদের মেডিকেল ফি ১০০০ টাকা ও ফিঙ্গারপ্রিন্টের ফি ২২০ টাকা দিতে হয়। বোয়েসেলের মাধ্যমে সাধারণ কর্মীদের জর্ডানে যেতে এর বাইরে কোনো টাকা খরচ নেই। তবে শুধু উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কিছু পদে অতিরিক্ত খরচ কর্মীকে বহন করতে হয়।
ঢাকায় তিনটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে কর্মীদের সরাসরি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। জর্ডানের যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়, তাদের প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎকার নিয়ে থাকেন। বোয়েসেলের ব্যবস্থাপক (প্রটোকল) সমর কুমার রনি প্রথম আলোকে বলেন, সাক্ষাৎকারে প্রার্থীর আগ্রহ ও কাজের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র, বাংলাদেশ-জার্মান কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ-কোরিয়া টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে (বিকেটিটিসি) সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় প্রতি শুক্রবার সকাল আটটায় সাক্ষাৎকার শুরু হয়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ কেন্দ্রে সাক্ষাৎকারের জন্য উপস্থিত হতে হয়।
রঙিন ছবি চার কপি (পাসপোর্ট সাইজ), মূল পাসপোর্ট, পাসপোর্টের ফটোকপি এক সেট রঙিন ও চার সেট সাদা–কালো, শিক্ষাগত অভিজ্ঞতার সনদ (যদি থাকে)।
দিনে আট ঘণ্টা ডিউটি, সপ্তাহে ছয় দিন এবং ওভারটইম (স্বেচ্ছাধীন)। চাকরির চুক্তি তিন বছর। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থাকা, খাওয়া ও প্রাথমিক চিকিৎসা এবং পরিবহনের ব্যবস্থা করবে। চাকরিতে যোগদানের বিমানভাড়া এবং তিন বছর চাকরি শেষে দেশে ফেরত আসার বিমানভাড়া নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান দেবে। চুক্তি শেষ হওয়ার আগে দেশে ফিরে আসতে চাইলে জর্ডানের শ্রম আইন প্রযোজ্য হবে। যাঁদের বিরুদ্ধে দেশে বা জর্ডানে মামলা আছে, তাঁরা নিয়োগের অযোগ্য হবেন।
সালমা আক্তার, মেশিন অপারেটর, নিডেল ক্রাফট গ্রুপ
জর্ডানের পোশাক কারখানা নিডেল ক্রাফট গ্রুপে তিন বছর ধরে মেশিন অপারেটর হিসেবে চাকরি করছেন বাংলাদেশি নারী কর্মী সালমা আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম যখন আসার সিদ্ধান্ত নিই, তখন একটা শঙ্কার মধ্যে ছিলাম। কিন্তু জর্ডানে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে সব উদ্বেগ কেটে যায়। এখানকার কর্মপরিবেশ অনেক ভালো।’
সালমা আক্তার বলেন, ‘থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার জন্য নিজের কোনো খরচ করতে হয় না। সব কোম্পানি দেয়। তাই মাসে যে বেতন পাই, তার পুরোটাই সঞ্চয় করা যায়। এভাবে তিন বছর চাকরি করার পর ভালো টাকা জমে। দেশে গিয়ে সেটা দিয়ে নিজে কিছু করা যায়। বিমা–সুবিধা থাকায় সেখান থেকেও চাকরি শেষে মোট অঙ্কের টাকা পাওয়া যায়।’
সালমা আক্তার বলেন, কোম্পানি থেকে কর্মীদের জন্য যেসব খাবার দেওয়া হয়, সেগুলোর মান অনেক ভালো। সব দেশের কর্মীদের জন্য আলাদা খাবারের ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশিরা তাঁদের দেশে যে ধরনের খাবার খান, তাঁদের জন্য সে রকম খাবারের ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া নেপালি ও শ্রীলঙ্কানরা যে ধরনের খাবার খান, তাঁদের জন্য সে রকমের খাবারের আয়োজন থাকে। সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার, সন্ধ্যার নাশতা ও রাতের খাবার বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। কেউ অসুস্থ হলে তাঁর জন্য তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।
যাঁরা জর্ডানে পোশাককর্মী হিসেবে যেতে চান, তাঁদের উদ্দেশে সালমা বলেন, নেতিবাচক কথায় কান না দিয়ে সাহস নিয়ে আসা উচিত। এখানে কাজ করে নিজে যেমন ভালো থাকা যায়, তেমনি পরিবারের জন্যও মাসে মাসে টাকা পাঠানো যায়। একজন সাধারণ পোশাককর্মী ওভারটাইমসহ মাসে ইচ্ছা করলে ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন।