শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা

বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে জট, চাকরিপ্রার্থীরা হতাশ

১৩তম পরীক্ষা নিয়ে মামলা

■ ১৫তম পরীক্ষার ফল বের হলেও নিয়োগ আটকে আছে

■ ১৬তম পরীক্ষার ফলের অপেক্ষায় ২,২৮০০০

■ করোনার কারণে স্থগিত ১৭তম পরীক্ষা

প্রতীকী ছবি

বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগজটে আটকা পড়েছেন হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী। এই পরীক্ষার আয়োজন করে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। এক বছর আগে ১৫তম এনটিআরসিএ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হলেও নিয়োগ পাননি ১১ হাজারের বেশি চাকরিপ্রার্থী। তাঁদের নিয়োগ আটকে আছে ১৩তম পরীক্ষা নিয়ে মামলার কারণে। এ জটিলতায় পড়ে অপেক্ষমাণ প্রার্থীদের অনেকেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি পাবেন না। কারণ, চাকরিতে প্রবেশের জন্য নির্ধারিত ৩৫ বছর পেরিয়ে গেলে তাঁরা চাকরির সুযোগ হারাবেন।

এদিকে এনটিআরসিএর আইন অনুযায়ী লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফলাফল দিতে হবে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও ফল প্রকাশ করা হয়নি। ১৬তম নিবন্ধনের (লিখিত পরীক্ষা) ফলের অপেক্ষায় আছেন ২ লাখ ২৮ হাজার প্রার্থী। কবে ফল প্রকাশিত হবে, সবাই নিয়োগ পাবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আর করোনার কারণে স্থগিত হওয়া ১৭তম নিবন্ধনের আবেদনকারী সাড়ে ১১ লাখ প্রার্থী জানেন না প্রিলিমিনারি পরীক্ষা কবে হবে।

এ পর্যন্ত দুটি গণবিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে দুই দফায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে এনটিআরসিএ। এতে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে নিয়োগ পেয়েছেন প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষক। এখন তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি জারির অপেক্ষায় এনটিআরসিএ।

এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান মো. আকরাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবকিছু নিয়েই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের অপেক্ষায় আছি। অনুমতি পেলেই এসব বিষয় নিষ্পত্তি করা হবে।’

এনটিআরসিএ মূলত ২০০৫ সাল থেকে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য নিবন্ধন পরীক্ষার আয়োজন করে। এ পর্যন্ত একটি বিশেষ পরীক্ষাসহ মোট ১৫টি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা হয়েছে। শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা এনটিআরসিএ আয়োজন করে থাকলেও নিয়োগ চূড়ান্ত করত সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠলে ২০১৫ সাল থেকে এনটিআরসিএকে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

নীতিমালায় বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষক চাহিদা পাঠাবে এনটিআরসিএতে। সেখান থেকে নির্বাচিত বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের তালিকা পাঠানো হবে প্রতিষ্ঠানে। সে তালিকা থেকেই শিক্ষক নিয়োগ দেবে প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ এখন শুধু শিক্ষকের নিয়োগপত্র জারি করবে।

এ পর্যন্ত দুটি গণবিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে দুই দফায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে এনটিআরসিএ। এতে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে নিয়োগ পেয়েছেন প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষক। এখন তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি জারির অপেক্ষায় এনটিআরসিএ।

শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা তিনটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে প্রিলিমিনারি। এতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের দ্বিতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়।

পরবর্তী ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এরপর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে সব পরীক্ষায় পাস করার পর যাঁদের বয়স ৩৫ অতিক্রম করে না, তাঁরাই চাকরির যোগ্য বলে বিবেচিত হন।

আটকে আছে ১৫তম নিবন্ধন নিয়োগ

১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয় গত জানুয়ারিতে। মোট তিন স্তরে ১১ হাজার ১৩০ জন পরীক্ষার্থী চূড়ান্তভাবে পাস করেন। তাঁদের মধ্যে স্কুল পর্যায়ে পাস করেন ৯ হাজার ৬৩ জন, স্কুল পর্যায়ে দ্বিতীয় দফায় ৬১১ এবং কলেজ পর্যায়ে ১ হাজার ৪৫৬ জন। প্রায় ১০ মাস আগে চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হলেও নিয়োগ হয়নি এসব প্রার্থীর।

এনটিআরসিএ জানায়, তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি জারির ঠিক আগমুহূর্তে নিয়োগ পেতে ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধনে চাকরিবঞ্চিত ২ হাজার ২০০ জন হাইকোর্টে মামলা করেন। মামলায় রায় তাঁদের পক্ষে গেলে তাদের নিয়োগ দিতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। এ কারণে ১৫তম নিবন্ধনের তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি জারিতে দেরি হয়। এখন এনটিআরসিএ এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার পরিকল্পনা করছে।

নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে এনটিআরসিএ থেকে জানানো হয়, ১৩তম নিবন্ধনের মামলার কার্যক্রম শেষ হলে ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন সম্পর্কে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দিন থেকে যাঁদের বয়স ৩৫ বছর, তাঁরাই নিয়োগের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

অপেক্ষা আর হতাশা

চূড়ান্ত পরীক্ষায় পাস করে নিয়োগের অপেক্ষায় আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘তিন বছর ধরে তিন ধাপে পরীক্ষা দিয়ে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। আমাদের আবেদনের বয়সসীমা ৩৫। চূড়ান্ত পরীক্ষায় পাস করেও যদি বয়সের কারণে চাকরিতে যোগ দিতে না পারি, তাহলে এর চেয়ে আর হতাশার কী হতে পারে। এনটিআরসিএর কালক্ষেপণের দায় কেন আমাদের নিতে হবে?’

রাজধানীর তিতুমীর কলেজের অর্থনীতি বিভাগ থেকে পাস করা মো. শান্ত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চূড়ান্তভাবে পাস করলেও এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি। তাই পাস করেও নিয়োগ না হওয়ায় বেকার জীবন পার করতে হচ্ছে।’

নিয়োগের জন্য যোগ্য হলেও যাঁরা নিয়োগ পাচ্ছেন না, তাঁদের বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান মো. আকরাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সঙ্গে কথা বলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।

আটকে আছে ১৬তম পরীক্ষার ফল

প্রায় এক বছর আগে ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হলেও এখনো ফল প্রকাশ হয়নি। অথচ আইন অনুসারে ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশের কথা। গত বছরের ২৩ মে ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এতে আটকে আছে ২ লাখ ২৮ হাজার প্রার্থীর ভবিষ্যৎ।

ওই পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সাব্বির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণত তাঁরাই এ পরীক্ষায় অংশ নেন, যাঁদের সরকারি চাকরি হয়নি। এক বছরের বেশি সময় চলে গেছে, ফল প্রকাশিত হয়নি। আমরা হতাশ হয়ে পড়েছি।’

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এনটিআরসিএর একটি সূত্র জানায়, ১৬তম নিবন্ধনের ফলাফল তৈরি থাকলেও মন্ত্রণালয়ে মৌখিক নির্দেশে তা আটকে আছে।

সবকিছু নিয়েই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের অপেক্ষায় আছি। অনুমতি পেলেই এসব বিষয় নিষ্পত্তি করা হবে
আকরাম হোসেন, এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান

করোনায় ১৭তম নিয়ে অনিশ্চয়তা

এনটিআরসিএ থেকে জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭৭ হাজার পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ১৭তম বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রায় ১১ লাখ ৬৫ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। এসব চাকরিপ্রার্থীও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছেন। তাঁদের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা গত ১৫ মে হওয়ার কথা থাকলেও করোনার জন্য তা স্থগিত হয়েছে। কবে পরীক্ষা হবে, তা-ও জানেন না প্রার্থীরা।

তবে নিয়োগ‍জটের অবসানে এখনই পরিকল্পনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, লিখিত পরীক্ষার ফল যদি তৈরি থাকে, তা প্রকাশ না করার কোনো যুক্তি নেই। আর প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় দেরি করার কোনো কারণ দেখি না। এখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরীক্ষা নেওয়া যায়। নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও যোগ্য প্রার্থীরা নিয়োগবঞ্চিত হবেন, এটা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না।