চাকরির লিখিত পরীক্ষায় বাংলা সাহিত্যের ওপর প্রশ্ন হয়। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য সময় বেশি পাওয়া যায় না। তাছাড়া কী লিখতে হবে, সেটিই প্রার্থীদের ভালো করে জানা থাকে না। এমনকি সাহিত্যের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কেমন করে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত, এটিও অনেকের জানা নেই। সাহিত্যের প্রশ্নের উত্তর কীভাবে লিখবেন এবং কেমন করে প্রস্তুতি নেবেন, এসব নিয়েই আজ আলোচনা করা হচ্ছে।
সাহিত্যের প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য সময়ের দিকে নজর রাখতে হবে। যেমন, বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় বাংলা সাহিত্যের ১০টি প্রশ্ন থাকে। ১০টি প্রশ্নেরই উত্তর লিখতে হয়। প্রতিটি প্রশ্নের মান ৩। অর্থাৎ সাহিত্যের জন্য ৩০ নম্বর বরাদ্দ। উত্তর লেখার জন্য মোটামুটি ৩৫-৪০ মিনিটি সময় পাবেন। একইভাবে যে কোনো লিখিত পরীক্ষায় এ ধরনের প্রশ্নের ক্ষেত্রে সময়ের দিকে নজর রেখে উত্তর লিখবেন। উত্তরের আয়তন নিয়ে ভাবার দরকার নেই।
সময়ের কারণে উত্তর সংক্ষিপ্ত হয়। এক্ষেত্রে ছোট ছোট অনুচ্ছেদে উত্তরটি উপস্থাপন করতে হবে। একেকটি অনুচ্ছেদে বাক্য সংখ্যা ১-২টি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪-৫টি পর্যন্ত হতে পারে। নানা ধরনের তথ্য দিয়ে উত্তরটি সাজাতে হবে। প্রিলিমিনারি বা এমসিকিউ পরীক্ষার জন্য যেসব তথ্য শিখেছেন, লিখিত খাতার উত্তরে সেসব তথ্যই গুছিয়ে লিখুন। তবে মাথায় রাখবেন, প্রশ্নের সঙ্গে যেন তথ্যগুলো প্রাসঙ্গিক হয়।
ধরা যাক একটি প্রশ্ন এমন: ‘রোকেয়াকে কেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয়?’ এ ধরনের প্রশ্নে সবাই একটি কথাই নানাভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে লিখে উত্তরটি বড় করেন। প্রায় সবাই এভাবে উত্তরটি লেখেন: ‘রোকেয়াকে নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয়। তিনি বাঙালি পশ্চাৎপদ নারীসমাজের অগ্রগতি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি নারীকে পর্দাপ্রথার বাইরে এনে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। বেগম রোকেয়া পুরুষ ও নারীর সম-অধিকারের কথা বলেছেন।’ খেয়াল করে দেখুন এ উত্তরে তথ্য নেই। তাছাড়া যেসব কথা বলা হয়েছে, সেগুলো বিভ্রান্তিমূলক অথবা ত্রুটিযুক্ত।
ওপরের প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য নিচের তথ্যগুলো ব্যবহার করতে পারেন:
বিশ শতকের গোড়ার দিকেও বাঙালি মুসলমান সমাজ নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) নারী জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
রোকেয়ার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পাঁচটি: মতিচূর ১ম খণ্ড, মতিচূর ২য় খণ্ড, অবরোধবাসিনী, সুলতানাস ড্রিম ও পদ্মরাগ।
রোকেয়া নারীর তিনটি অধিকারের কথা জোর দিয়ে বলেছেন। এগুলো হলো- শিক্ষার অধিকার, কর্মসংস্থানের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার।
‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে রোকেয়া সংসার-জীবনকে দুই চাকাবিশিষ্ট গাড়ির সাথে তুলনা করেছেন। এর একটি চাকা স্বামী এবং অন্য চাকা স্ত্রী। চাকা দুটি অসমান হলে গাড়ি এক জায়গাতেই ঘুরতে থাকবে। তাই তিনি সমাজে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।
নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
উত্তরের সাথে সম্পর্কিত তথ্যগুলোই লিখবেন। একটি উত্তর লেখা শেষ হলে পর্যাপ্ত ফাঁক রেখে আরেকটি উত্তর শুরু করবেন। প্রশ্নের ক্রম রক্ষা করে উত্তর দেবেন। উত্তর এতো দীর্ঘ করবেন না যাতে আরেকটি উত্তর লেখার সময় নষ্ট হয়। কবি-লেখকদের নামের বানান ঠিক করে লিখুন।
প্রশ্নের উত্তরে কোনো উক্তি ব্যবহার করার প্রয়োজন হলে নিজের ভাষায় লিখুন। ওপরের উদাহরণে খেয়াল করে দেখুন, ‘অর্ধাঙ্গী’ থেকে নেওয়া উদ্ধৃতি রোকেয়ার ভাষায় না দিয়ে নিজের মতো করে লেখা হয়েছে। অনেকে কষ্ট করে উক্তি মুখস্থ করে উদ্ধৃতিচিহ্ন দিয়ে পরীক্ষার খাতায় লেখেন। এর কোনো দরকার নেই। বরং বক্তব্যটুকু বুঝে নিয়ে নিজের ভাষায় লেখাই যুক্তিযুক্ত। তবে কবিতার উদ্ধৃতি হলে যথাযথভাবে লিখতে হবে, কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। যে কোনো উদ্ধৃতির শেষে সূত্র লেখা ভালো। যেমন, ‘কালকেতু উপাখ্যানে’ ফুল্লরার উদ্দেশ্যে কালকেতু বলেছে:
শাশুড়ি ননদি নাহি নাহি তোর সতা।
কার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করি চক্ষু কৈলি রাতা।।
(‘কালকেতু উপাখ্যান’: মুকুন্দরাম চক্রবর্তী)
অনেকে পরীক্ষার খাতায় লেখার জন্য দুই রঙের কালি ব্যবহারে স্বস্তিবোধ করেন। তাদের জন্য আলাদা করে বলার কিছু নেই। তবে, হাতের লেখা পরিচ্ছন্ন হলে এক রঙের কালি ব্যবহার করলেই চলে। ভালো বলপয়েন্ট কলম দিয়ে লেখা উচিত। আর সময় থাকলে খাতায় পেনসিল দিয়ে মার্জিন দিয়ে নিতে পারেন। মার্জিন কেবল বাঁয়ে ও উপরে দিতে হবে। খাতার চারদিকে মার্জিন দেওয়া যাবে না। মার্জিনের বিকল্প হিসেবে খাতা ভাঁজ করা ঠিক নয়।
বিগত কয়েক বছরের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করুন। এগুলো পর্যবেক্ষণ করলে প্রশ্নের ধরন সম্পর্কে ধারণা পাবেন। এগুলোর ভিত্তিতে কী কী ধরনের প্রশ্ন হতে পারে, তার একটি তালিকা করুন। তারপর সংক্ষিপ্ত তথ্য দিয়ে সাজিয়ে উত্তরের কাঠামো তৈরি করুন। একেকটি সাদা কাগজে একেকটি প্রশ্নের উত্তর লিখুন। এরপর কাগজগুলো বিষয় অনুযায়ী সাজিয়ে ফাইলবন্দী করুন। কোনো বিষয় থেকে প্রশ্ন অনুমান করতে না পারলে সাদা কাগজের উপরে শিরোনাম লিখে ওই বিষয়ের তথ্যগুলো বুলেট দিয়ে টুকে রাখুন। পরে পরীক্ষার হলে প্রশ্ন অনুযায়ী সেখান থেকে তথ্য ব্যবহার করে উত্তর লিখতে পারবেন।
একটি ছোট পকেট সাইজের নোটবুক সবসময় সঙ্গে রাখুন। যেসব তথ্য একটু কঠিন মনে হয়, কিংবা কবিতার যেসব উক্তি মুখস্থ করা দরকার বলে মনে হয়, সেগুলো নোটবুকে টুকে রাখুন। রাস্তায়, গাড়িতে, অবসরে যখনই সময় পাবেন নোটবুক বের করে তথ্য বা উক্তি বের করে মুখস্থ করুন।
প্রাচীনযুগ থেকে ‘চর্যাপদ’ দেখবেন। মধ্যযুগ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, বৈষ্ণব পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, শ্রীচৈতন্য, প্রণয় উপাখ্যান, ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’, দোভাষী পুথি দেখবেন। আধুনিক যুগ থেকে কবি-লেখকদের ওপর প্রশ্ন হয়। বিশেষভাবে দেখবেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, পাঁচজন কবি যাঁরা ‘পঞ্চপাণ্ডব’ নামে পরিচিত ইত্যাদি। এছাড়া ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ের সাহিত্যকে বলা হয় বাংলাদেশের সাহিত্য। এ সময়কার কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ; ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শহীদুল্লা কায়সার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত ওসমান; নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক; গল্পকার শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক—এঁদেরকে ভালো করে দেখবেন।
কবি-লেখকদের নামের সঙ্গে বন্ধনিতে জন্ম ও মৃত্যু সাল লিখুন। যেসব কবি-লেখক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাঁদের জন্ম-মৃত্যু সাল মনে রাখুন। প্রথমবার কবি-লেখকদের পূর্ণ নাম লিখুন। তাঁদের নামের সঙ্গে দীর্ঘ বিশেষণ ব্যবহার করার দরকার নেই। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক বা প্রবন্ধের নামে কিংবা বইয়ের নামে ঊর্ধ্বকমা ব্যবহার করুন। গল্প-উপন্যাস-নাটকের চরিত্রের নামে কিংবা লেখকের নামে ঊর্ধ্বকমা ব্যবহার করবেন না। প্রশ্নে যদি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য জানতে চায়, শুধু সেটুকুই লিখবেন। যেমন, যদি প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটি রূপক-সাংকেতিক নাটকের নাম লিখতে বলে, তবে ঊর্ধ্বকমা দিয়ে তিনটি রূপক-সাংকেতিক নাটকের নামই লিখুন।
তারিক মনজুর
শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়