বাংলাদেশ বিষয়াবলির প্রস্তুতির জন্য করণীয়

৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা ২৭ নভেম্বর শুরু। প্রার্থীদের প্রস্তুতির সুবিধার জন্য লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতির পরামর্শ প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ চতুর্থ পর্বে বাংলাদেশ বিষয়াবলি বিষয়ে প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছেন ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন

মডেল: নুসরাত, হাদী ও ইয়াসফি

লিখিত পরীক্ষায় বাংলাদেশ বিষয়াবলির ২০০ নম্বরের জন্য সময় বরাদ্দ থাকে চার ঘণ্টা। বাংলাদেশ বিষয়াবলির লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস বড় হওয়ায় অনেক প্রার্থীই প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হিমশিম খেয়ে থাকেন। উপযুক্ত কৌশল না জানা এবং গুরুত্বপূর্ণ টপিক বাছাই করতে না পারার কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় কৌশল সম্পর্কে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।

সিলেবাস ও অধ্যায় বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ বিষয়াবলির সিলেবাসে মোট ১৬টি অধ্যায়। সব অধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ নয়। এগুলোর মধ্যে প্রথম অধ্যায় (বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিচিতি), চতুর্থ অধ্যায় (বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি), ষষ্ঠ অধ্যায় (প্রাকৃতিক সম্পদ), সপ্তম অধ্যায় (সংবিধান), অষ্টম অধ্যায় (সরকারের অঙ্গসমূহ) এবং ষষ্ঠদশ অধ্যায় (মুক্তিযুদ্ধ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ অধ্যায়গুলো থেকেই বেশির ভাগ প্রশ্ন হয়ে থাকে। এগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করলে ১২০ থেকে ১৫০ নম্বর পর্যন্ত কমন পাওয়া যাবে। এ ছাড়া দ্বিতীয় অধ্যায় (জনসংখ্যা), তৃতীয় অধ্যায় (ইতিহাস), পঞ্চম অধ্যায় (পরিবেশ), দশম অধ্যায় (রাজনৈতিক দল) এবং একাদশ অধ্যায় (নির্বাচন) থেকেও বেশ কিছু প্রশ্ন এসে থাকে। নবম অধ্যায় (পররাষ্ট্রনীতি) ও চতুর্দশ অধ্যায় (বিশ্বায়ন) আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির অন্তর্ভুক্ত। এগুলো নতুন করে পড়ার কিছু নেই। অবশিষ্ট দ্বাদশ অধ্যায় (তথ্যপ্রযুক্তি), ত্রয়োদশ অধ্যায় (সুশীল সমাজ) এবং পঞ্চদশ অধ্যায় (জেন্ডার ইস্যু) বাংলা ও ইংরেজি রচনার জন্যই বারবার পড়তে হয়। সুতরাং এ টপিকগুলো এখানে বাদ দিতে পারেন।

মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও পটভূমির জন্য লিখিত সিলেবাসে ৫০ নম্বর রয়েছে। যদিও সব সময় এই মানবণ্টন অনুসরণ করা হয় না। মুক্তিযুদ্ধ অংশের জন্য প্রিলিমিনারিতে সবাই অনেক পড়াশোনা করেন। তাই এ–সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ সবার ভালোমতো আয়ত্তে থাকার কথা। আগের তথ্যগুলো বারবার রিভিশন দিতে হবে এবং প্রচলিত যেকোনো লিখিত গাইড বই থেকে এই অংশটুকু পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়ে ফেলতে হবে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম, মুজিবনগর সরকার, যুদ্ধাপরাধ, বিদেশি রাষ্ট্রের ভূমিকা, আত্মসমর্পণের দলিল, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন, সেক্টর ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো পড়তে হবে। মুক্তিযুদ্ধ–সংক্রান্ত টীকাগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

সংবিধান থেকে প্রতিবছরই ৩০ থেকে ৪০ নম্বরের প্রশ্ন আসে। সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ধারা ব্যাখ্যা আত্মস্থ করতে হবে। বাংলাদেশ বিষয়াবলির অনেক উত্তরের ক্ষেত্রেই সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলো উল্লেখ করে দিলে খুব ভালো নম্বর আশা করা যায়। ৪১তম বিসিএসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলভিত্তি কী জানতে চেয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ২৫তম অনুচ্ছেদটি উল্লেখ করে আলোচনা করলে খুব মানসম্মত উত্তর হবে। একইভাবে ৪৩তম বিসিএসে স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে প্রশ্ন এসেছিল। এই উত্তরের ক্ষেত্রেও সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে আলোচনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের অনুচ্ছেদ হুবহু মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই। প্রতিটি অনুচ্ছেদের মূলকথা নিজের ভাষায় উপস্থাপন করতে পারলেই যথেষ্ট। সংবিধানের ১ থেকে ৪৭তম অনুচ্ছেদ খুব ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে। এ ছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদগুলো হলো—৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৫, ৫৭, ৫৯, ৬১, ৬৩, ৬৪, ৬৫, ৬৬, ৬৭, ৭০, ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৭, ৮০, ৮১, ৮৪, ৮৭, ৯৩, ৯৪, ৯৫, ৯৬, ১০২, ১০৫, ১০৮, ১১৭, ১১৮, ১২১, ১২২, ১২৩, ১২৭, ১৩৭, ১৪১ক, ১৪১খ, ১৪২, ১৪৫ক, ১৪৬, ১৪৮ ও ১৫০। সংবিধান রচনার প্রেক্ষাপট, প্রস্তাবনা, বৈশিষ্ট্য, তফসিল এবং সংশোধনীগুলোও গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে প্রতি বিসিএসেই বেশ কিছু প্রশ্ন আসে। ইপিজেড, বেজা, বেপজা, পিপিপি, দারিদ্র্য বিমোচন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, রূপকল্প-৪১, জিডিপি, জিএনপি, একনেক, খাদ্যনিরাপত্তা, মেগা প্রজেক্ট, রেমিট্যান্স, রিজার্ভ, কৃষি, শিল্প-বাণিজ্য, বনজ সম্পদ, চামড়া শিল্প, পোশাক শিল্প, পর্যটন শিল্প, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, মানবসম্পদ, সামাজিক নিরাপত্তা, বিনিয়োগ, নদী, জ্বালানি, শিক্ষানীতি, এসডিজি, সামাজিক সমস্যা ও কর্মমুখী শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ বিষয়াবলির এই অংশে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত, চার্ট, টেবিল, কোটেশন এবং অন্যান্য পরিসংখ্যানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। অর্থনৈতিক সমীক্ষা, বাজেট, পত্রিকা, সরকারি ওয়েবসাইট, জাতীয় তথ্য বাতায়ন, উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে প্রয়োজনীয় ডেটা সংগ্রহ করতে হবে।

ভূগোল, পরিবেশ ও জনসংখ্যা
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-রাজনীতি, প্রবাল দ্বীপ, বঙ্গোপসাগরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, সুন্দরবন, বিভিন্ন অঞ্চল, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ সম্পর্কে জানতে হবে। ভূগোল থেকে সাধারণত প্রতি এক বছর পরপর প্রশ্ন আসে। ৪৪তম বিসিএসে ভূগোল থেকে কোনো প্রশ্ন হয়নি। তাই এবার এ–সংক্রান্ত প্রশ্ন আসার সম্ভাবনা বেশি। ভূগোল–সংক্রান্ত প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট মানচিত্র দিতে পারলে বেশি নম্বর পাওয়া যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশের জনসংখ্যা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, পার্বত্য চট্টগ্রাম, পরিবার পরিকল্পনা ও দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও জেনে রাখা উচিত। ভূগোলের জন্য নবম-দশম শ্রেণির ভূগোল বোর্ড বই খুব সহায়ক হতে পারে।

রাজনৈতিক দল, সরকার ও নির্বাচন
সরকারের আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ, সুশাসন, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, রাজনৈতিক দল, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নির্বাচনব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী আইন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা রাখতে হবে। এ–সংক্রান্ত অধ্যায়গুলো থেকে প্রতিবছরই প্রশ্ন আসে। সংশ্লিষ্ট তথ্যগুলো নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বই থেকে পড়ে নিতে পারেন।

বিশেষভাবে লক্ষণীয়

  • আগের প্রশ্ন পড়া
    ৩৫তম বিসিএস থেকে ৪৪তম বিসিএস পর্যন্ত বাংলাদেশ বিষয়াবলির আগের সব প্রশ্ন বিশ্লেষণ করতে হবে এবং সেগুলো ভালোভাবে পড়ে নিতে হবে। এগুলো আগে এসেছে, তাই সামনে আসবে না এমন মানসিকতা অবশ্যই পরিহারযোগ্য। আগের প্রশ্ন বিশ্লেষণ করলে খুব সহজেই প্রশ্নের পদ্ধতি সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ বিষয়াবলির সব প্রশ্ন কমন পাওয়া খুব কঠিন।

  • সময় ব্যবস্থাপনা
    লিখিত পরীক্ষায় অন্য যেকোনো বিষয়ের তুলনায় বাংলাদেশ বিষয়াবলিতে বেশি লিখতে হয়। সর্বশেষ তিনটি বিসিএসের প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৪১তম বিসিএসে ৩০টি, ৪৩তম বিসিএসে ২৭টি এবং ৪৪তম বিসিএসে ৩৩টি প্রশ্ন এসেছিল। এর মধ্যে টীকায় দু–একটি প্রশ্ন বেশি থাকে। অন্যান্য প্রশ্নগুলোতে কোনো বিকল্প নেই, সব উত্তর করতে হয়। বাংলাদেশ বিষয়াবলির পরীক্ষায় বেশির ভাগ পরীক্ষার্থী সময় ব্যবস্থাপনায় গড়মিল করে থাকেন। কিছু প্রশ্নের উত্তর বিস্তারিত লিখতে গিয়ে শেষের দিকে সময়ের অভাবে অনেক প্রশ্ন লেখারই সুযোগ পান না। এই বিষয়ের পরীক্ষার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সব প্রশ্নের উত্তর করে আসা। যেহেতু ২০০ নম্বরের জন্য ৪ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ, তাই প্রতি ৫ নম্বরের প্রশ্নের জন্য ৬ মিনিট, ১০ নম্বরের প্রশ্নের জন্য ১২ মিনিট এবং ২০ নম্বরের প্রশ্নের জন্য ২৪ মিনিট সময় ধরে লিখতে হবে। তবে যদি আপনি কিছু প্রশ্নের উত্তর খুব ভালো পারেন এবং কিছু প্রশ্ন আপনার জন্য আনকমন হয়, তাহলে জানা প্রশ্নগুলোতে কিছু সময় বেশি দিতে পারেন এবং অবশিষ্ট প্রশ্নগুলোও কিছু না কিছু লেখার চেষ্টা করবেন। লিখিত পরীক্ষায় যেহেতু নেগেটিভ মার্কিং নেই, তাই কোনো প্রশ্নের উত্তর না লিখে পরীক্ষার হল ত্যাগ করবেন না।

  • সুন্দর উপস্থাপনা
    বাংলাদেশ বিষয়াবলির পরীক্ষায় উপস্থাপন কৌশল এবং ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পয়েন্ট টু পয়েন্ট লিখতে হবে। হাতের লেখা খারাপ হলেও সেটা যেন স্পষ্ট ও বোধগম্য হয়, তা লক্ষ রাখতে হবে। অনেকেই মনে করেন, এই বিষয়ের পরীক্ষায় শত শত পৃষ্ঠা না লিখলে ভালো নম্বর পাওয়া যায় না—এটা একদমই ভুল ধারণা। পরীক্ষার খাতায় গল্পগুজব না লিখে টু দ্য পয়েন্টে উত্তর করতে হবে।

  • পর্যাপ্ত তথ্য দেওয়া
    বাংলাদেশ বিষয়াবলির বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে ডেটা, কোটেশন, রেফারেন্স, গ্রাফ, চার্ট ইত্যাদি দেওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে প্রস্তুতির সময়েই সর্বশেষ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, বাজেট, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড–সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো নোট করে রাখতে হবে। এগুলো বারবার রিভিশন দিতে হবে, যাতে পরীক্ষার খাতায় সংশ্লিষ্ট তথ্য নির্ভুলভাবে লিখে আসা যায়। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে কিছু কিছু ডেটা সংযুক্ত করলে উত্তরের মান বেড়ে যাবে।

  • নিয়মিত পত্রিকা পড়া
    বাংলাদেশ বিষয়াবলি, বাংলা-ইংরেজি রচনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে ভালো করার জন্য নিয়মিত পত্রিকা পড়ার কোনো বিকল্প নেই। পত্রিকা পড়ার সময় জরুরি তথ্যগুলো খাতায় নোট করে রাখবেন। পত্রিকা যত পড়বেন, আপনার লেখার মান ও উপস্থাপনা ততই বাড়বে।