বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন আসে
বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন আসে

একুশ নিয়ে চাকরিতে যেসব প্রশ্ন আসে

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী উল্লেখযোগ্য দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এই দিনে শহীদ হন নাম জানা না–জানা অনেক মানুষ। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয় কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ; নির্মিত হয় শহীদ মিনার, চলচ্চিত্র। বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় এসব বিষয় থেকে প্রশ্ন আসে। এখানে ভাষা আন্দোলনসম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া হলো।

  • প্রথম ভাষাশহীদ
    একুশের প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্রনাথ কলেজের বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তাঁর বাবার নাম আবদুল লতিফ এবং মায়ের নাম রাফিজা খানম। রফিক উদ্দিনের জন্ম ১৯২৬ সালে, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি শহীদ হন। ঘটনার সময় পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের কারণে ছাত্ররা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ব্যারাকে আশ্রয় নেন। ওই সময় পুলিশের গুলিতে তাঁর মাথার খুলি উড়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তখনই মারা যান তিনি। ম্যাজিস্ট্রেট ওবায়দুল্লাহর উপস্থিতিতে তাঁর জানাজার নামাজ পড়ান আজিমপুর মসজিদের ইমাম হাফেজ আবদুল গফুর। আত্মীয়স্বজনকে না জানিয়ে গোপনে আজিমপুর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। ভাষাশহীদ রফিক ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পান।

  • প্রথম শহীদ মিনার
    প্রথম শহীদ মিনার ছিল ১১ ফুট লম্বা ৩ স্তরবিশিষ্ট একটি স্তম্ভ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রনেতা গোলাম মওলা ও তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগে স্তম্ভটি গড়ে তোলা হয়। মেডিকেল কলেজের প্রায় ৩০০ ছাত্র ছিলেন এই উদ্যোগের পেছনে। ২৩ ফেব্রুয়ারি মিনার তৈরির কাজ শেষ হয়। এই স্তম্ভের মূল নকশা করেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বদরুল আলম। নকশা থেকে শুরু করে নির্মাণ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মেডিকেলের আরেক ছাত্র সাঈদ হায়দার। নির্মাণের ৩ দিন পর ২৬ ফেব্রুয়ারি মিনারটি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তান সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আলাউদ্দিন আল আজাদ রচনা করেন কবিতা ‘স্মৃতিস্তম্ভ’। সেখানে কবি বলেন: ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কী বন্ধু, আমরা এখনো চার কোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো।’

  • প্রথম লিফলেট
    ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ণের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ওই দিন সন্ধ্যায় একটি লিফলেট তৈরি হয়। এ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুস্তফা নূরউল ইসলাম, ফজলে লোহানী এবং হাসান হাফিজুর রহমান। পাটুয়াটুলির সওগাত অফিসের বিপরীত গলির পাইওনিয়ার প্রেসে লিফলেটটি ছাপা হয়। সেখানে লেখা ছিল, ‘বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী, শাসকগোষ্ঠীর কবর রচনা করব।’ এটি লিখেছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। আর ছাপানোর দায়িত্ব পালন করেন হাসান হাফিজুর রহমান। রাতেই লিফলেটটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পলাশী ব্যারাক এলাকায় বিতরণ করা হয়।

  • প্রথম কবিতা
    একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে লেখা প্রথম কবিতার নাম ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। কবিতাটির রচয়িতা মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় কবিতাটি রচিত হয়। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে কবিতাটি আবৃত্তি করেন চৌধুরী হারুন অর রশিদ। ১৭ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এ কবিতা ছাপা হয় কোহিনুর প্রেস, আন্দরকিল্লা থেকে। এর প্রকাশক কামালউদ্দিন খান। দাম ধরা হয় দুই আনা।

  • প্রথম গান
    একুশের প্রথম গান ‘ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’। গানটি ভাষাসৈনিক আ ন ম গাজিউল হকের লেখা। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানের জনসভায় গানটি গাওয়া হয়।

  • প্রভাতফেরির প্রথম গান
    প্রকৌশলী মোশাররফ উদ্দীন আহমদ প্রভাতফেরিতে গাওয়ার জন্য প্রথম গান রচনা করেন। গানটির লাইন ছিল, ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে, আজিকে স্মরিও তারে’। ১৯৫৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে গানটি লেখা হয়। গানটি হয়ে ওঠে একুশের প্রথম বার্ষিকীর প্রভাতফেরির গান। আলতাফ মাহমুদ এই গানে সুর সংযোজন করেন। সুরকার আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে প্রথম কণ্ঠ মেলান শিল্পী সংসদের নিজামুল হক, মোমিনুল হক ও ছাত্রনেতা গাজীউল হক।

  • প্রথম সংকলন
    একুশের প্রথম সংকলনের নাম একুশে ফেব্রুয়ারি। সম্পাদনা করেন হাসান হাফিজুর রহমান। সংকলনটি প্রকাশ করেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী মোহাম্মদ সুলতান। সংকলনে ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’ শিরোনামে আলী আশরাফের একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়। এ সংকলনে শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালুদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক এবং হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা ছাপা হয়। গল্প ছাপা হয় শওকত ওসমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম এবং আতোয়ার রহমানের। গান ছিল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও তোফাজ্জল হোসেনের।

    এ ছাড়া সংকলনে ‘একুশের ইতিহাস’ শিরোনামে একটি রচনা ছিল, যেটি কবির উদ্দিন আহমদের লেখা। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনের স্কেচ করেন মূর্তজা বশীর। হাসান হাফিজুর রহমানের অনুরোধে উৎসর্গপত্র লিখে দেন আনিসুজ্জামান। সংকলনটি ছাপেন এম এ মুকিত, পাইওনিয়ার প্রেস থেকে। ক্রাউন সাইজে ছাপা ১৮৩ পৃষ্ঠার এ সংকলনের দাম রাখা হয় দুই টাকা আট আনা। এটি প্রকাশের পর প্রকাশকের আস্তানায় তল্লাশি চালায় পুলিশ। শেষ পর্যন্ত সংকলনটিকে নিষিদ্ধ করে সরকার। পরে ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।

  • প্রথম স্মরণিকা
    ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় চার পৃষ্ঠার স্মরণিকা। শহীদদের স্মরণে ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাসের পক্ষ থেকে এটি বের করা হয়। এ স্মরণিকায় ছাপা হয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। এ ছাড়া স্মরণিকায় ছিল ‘আমাদের কথা’ ও ‘ভুলি নাই রক্তরাঙা একুশের কথা’ শিরোনামে দুটি ছোট প্রবন্ধ। উৎসর্গপত্রে লেখা হয়: ‘ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাসের পক্ষ থেকে জাতীয় জীবনে চিরস্মরণীয় একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, সেই বীর শহীদদের স্মরণে’।

  • প্রথম নাটক
    একুশের প্রথম নাটক মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’। রচনার সময় নাট্যকার কারাগারে বন্দী ছিলেন। আরেক বন্দী রণেশ দাশগুপ্ত অন্য সেলে বন্দী মুনীর চৌধুরীকে একুশের ঘটনার ওপর একটি নাটক লিখে দেওয়ার অনুরোধ করে চিরকুট পাঠান। মুনীর চৌধুরী ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি নাটকটি লিখে শেষ করেন। ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি, রাত ১০টায় কয়েদখানার বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পর হারিকেনের আলোয় নাটকটি অভিনীত হয়। এতে অভিনয় করেন নলিনী দাস, অজয় রায় এবং জেলখানার অন্য কয়েদিরা।

  • প্রথম উপন্যাস
    একুশের প্রথম উপন্যাস জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’। শহীদ দিবস পালন, শহীদ মিনার নির্মাণ এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সমন্বয় ঘটিয়ে এই উপন্যাসের কাহিনি তৈরি করা হয়েছে। মুনিম, আসাদ, সালমা ও বজলে হাসান এ উপন্যাসের চরিত্র। উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে।

  • প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ
    একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার তিন মাস পর ভাষা আন্দোলন ও একুশের ইতিহাস নিয়ে লেখা হয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। গ্রন্থটির সম্পাদক অধ্যাপক (পরে প্রিন্সিপাল) আবুল কাশেম। এটি ১৯৫২ সালের জুন মাসে ‘আমাদের প্রেস’ থেকে মুদ্রিত হয়। বইটি প্রকাশ করে তমদ্দুন লাইব্রেরি।

  • প্রথম চলচ্চিত্র
    একুশের চেতনা নিয়ে নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’। সিনেমাটি পরিচালনা করেন জহির রায়হান। এতে অভিনয় করেন রাজ্জাক, সুচন্দা, আনোয়ার হোসেন, রোজী সামাদ, খান আতাউর রহমান ও রওশন জামিল। এ ছবির চিত্রগ্রাহক আফজাল চৌধুরী। চলচ্চিত্রের গানগুলোয় সুরারোপ করেন খান আতাউর রহমান।

    ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমার পরিবেশক আনিস ফিল্ম। মুক্তি পায় ১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল। এই চলচ্চিত্রে এক গৃহকর্ত্রীর স্বেচ্ছাচারী ভূমিকার মাধ্যমে পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রকে তুলে ধরা হয়েছে।

  • তারিক মনজুর
    শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়