পছন্দমতো চাকরি বা কাজ পাওয়াটা কঠিন। কারণ, চাকরিপ্রত্যাশীদের পক্ষে এটা জানা কঠিন যে নিয়োগদাতারা আসলে কেমন লোক খুঁজছেন। তাঁরা আসলে কেমন লোক চান নিয়োগ দিতে, তা চাকরিপ্রত্যাশীরা খুব একটা ঠাওর করতে পারেন না।
প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়োগপদ্ধতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। যেকোনো চাকরির জন্য মুখোমুখি ইন্টারভিউ এখনো বড় বিষয়। বড় বড় কোম্পানির নিয়োগকর্তারা মনে করেন, যেকোনো চাকরির ক্ষেত্রে ইন্টারভিউ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একজন ব্যক্তির সামনে বা প্যানেলের সামনে মুখোমুখি হয়ে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সামর্থ্য কারও ক্যারিয়ার যেমন গড়ে দিতে পারে, আবার শেষও করে দিতে পারে। তাই যেকারও চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকখানি নির্ভর করে ইন্টারভিউতে কতটা ভালো করেন, তার ওপর।কীভাবে ভাইভায় ভালো করবেন, এ বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো—
কারা আপনার সাক্ষাৎকার নেবেন, তাঁদের সম্পর্কে যতটা সম্ভব জেনে নিতে হবে। যাঁরা ইন্টারভিউ নেবেন, তাঁদের পদবি কী, তাঁরা কেমন—তাঁদের সম্পর্কে যতটা সম্ভব জেনে নিতে পারলে ভাইভা বোর্ড নিজেকে অনেকটাই এগিয়ে রাখা যায়। যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে চাইছেন, সেটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি কী নিয়ে কাজ করে, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী, স্বত্বাধিকারী কে বা কারা, বছরে তাদের আয়-ব্যয় কেমন, অর্থনৈতিক অবস্থা কী, প্রতিষ্ঠানটির মূল প্রতিযোগী কারা—এসব জানা দরকার। এসব জানার ভালো উপায় হলো ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট। সেটি ঘেঁটে নোট নিয়ে নিন, নিয়োগকর্তাদের নামগুলো জেনে নিন এবং কিছু প্রশ্ন নিজের মধ্য তৈরি করুন। ইন্টারভিউয়ের শেষ পর্যায়ে যখন আপনাকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হবে, তখন এমনভাবে প্রশ্ন করুন, যাতে আপনার সাক্ষাৎকারগ্রহীতারা বুঝতে পারেন, ওই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আপনি বেশ ভালোভাবে জানেন।
যেখানে কাজ করতে যাচ্ছেন, তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা থাকলে আপনার জন্য ইন্টারভিউ দেওয়া সহজ হবে। আপনি সহজেই তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন আর আত্মবিশ্বাসীও থাকবেন।
প্র্যাকটিস মেকস আ ম্যান পারফেক্ট—অনুশীলন এবং অনুশীলন একজনকে দিন দিন ত্রুটিহীন করে তোলে। আপনাকে কী ধরনের প্রশ্ন করা হতে পারে, তার একটি তালিকা তৈরি করে নিতে হবে। সম্ভাব্য উত্তরগুলোও ভেবে নিতে হবে। কী ধরনের প্রশ্ন করা হতে পারে, তা বুঝতে না পারলে ইন্টারনেটের সাহায্য নিতে পারেন। ইন্টারনেটে হাজারো ওয়েবসাইট আছে, যেখানে ইন্টারভিউতে সাধারণত কেমন প্রশ্ন করা হয়ে থাকে, সেগুলোর নমুনা উত্তরসহ পাওয়া যায়।
আপনার উত্তরগুলো থিওরির মতো না হয়ে গল্পের মতো হওয়াই ভালো। চাকরির ক্ষেত্রে যেসব যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে, সেগুলো যে আপনার আছে, সেটি গল্পের ছলে বলুন। আমি এসব কাজ পারি—এভাবে না বলে কাজের উদাহরণ দিতে পারেন। কখন, কোথায়, কীভাবে আপনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা জানান। এতে আপনার আগের কর্মক্ষেত্রে আপনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, সেটি যেমন বোঝা যাবে, তেমনি সাক্ষাৎকারগ্রহীতারা বুঝতে পারবেন, নতুন কাজের ক্ষেত্রে আপনি কতখানি যোগ্য।
আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারি—পুরোনো হলেও অনেক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বুদ্ধিমান নিয়োগকর্তারা অনেক সময় ইন্টারভিউ শুরুর ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। আপনি যতই ভালো ইন্টারভিউ দিন না কেন, আপনার পোশাক–পরিচ্ছদ দেখে ইন্টারভিউয়াররা যদি বিরক্ত হয়ে যান, তবে আদতে আপনার জন্য ভালো কোনো কিছু বয়ে আনবে না।
আপনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য যাবেন, হতেই পারে তারা পোশাক নিয়ে অত মাথা ঘামায় না। তবুও তারা এটা অন্তত আশা করে না যে ইন্টারভিউতে আপনি জিনস পরে যাবেন। খালি চোখে দেখতে আরাম লাগে এমন পোশাক পরুন। নিয়োগ বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে সাদা রংকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। রঙিন, জবরজং পোশাকের চেয়ে হালকা রঙের পোশাক পরাই ভালো। তবে পোশাকের রং যা–ই হোক, সাদা বা নীল, অবশ্যই তা যেন কুঁচকানো না হয়। ইন্টারভিউয়ের পোশাক হতে হবে পরিষ্কার ও পরিপাটি।
চাকরির ক্ষেত্রে বুদ্ধিমান নিয়োগকর্তারা কিন্তু হ্যান্ডশেকের ধরন দেখেও অনেক কিছু বিবেচনা করেন। সাধারণত প্রার্থী ইন্টারভিউ রুমে ঢোকার পরে প্রথমেই এটি হয়ে থাকে। একজন ইতিবাচক, আত্মবিশ্বাসী এবং পেশাদার লোক কখনোই কাঁপা কাঁপা, নিস্তেজ হাতে করমর্দন করবে না।
আবার হ্যান্ডশেকের সময় খুব বেশি শক্ত করেও হাত ধরা যাবে না। তাতে মনে হবে আপনি অন্যের ওপর জোর খাটাতে ওস্তাদ বা ব্যক্তি হিসেবে আপনি আক্রমণাত্মক ও কর্তৃত্ববাদী। দরকার হলে বন্ধুদের সঙ্গে করমর্দনের অনুশীলনও করে নিতে পারেন। বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করুন হ্যান্ডশেকের সময় আপনি তাঁদের হাতে বেশি চাপ দিচ্ছেন বা একেবারেই আলতো করে হাত ধরছেন কি না। ঠিকভাবে হ্যান্ডশেক করা অনুশীলন করুন।
আর ইন্টারভিউয়ের সময় যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন, অবশ্যই তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবেন। অন্যদিকে তাকানো বা নিচের দিকে তাকিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলাটা একধরনের অভদ্রতাই। পকেটে বা ব্যাগে অবশ্যই টিস্যু রাখবেন। মনে রাখবেন, ঘামে ভেজা হাত ধরতে কেউ পছন্দ করে না।
আপনার মাথার ভেতর অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, বুক ঢিপঢিপ করছে, নানা আশঙ্কায় নিজের নামই ভুলে যাওয়ার দশা—তখন হাসাটা অবশ্য একটু কঠিনই। তবে হাসিমুখ হলো একটা বিশ্বস্বীকৃত ভঙ্গি, যা দ্বারা আপনি সহজেই বোঝাতে পারেন, আমি দিলখোলা মানুষ এবং আমি এখানে আসতে পেরে খুশি। তাই ইন্টারভিউ কক্ষে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মুখে হাসি রাখুন, হাসিমুখে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরও দিন।
বডি ল্যাংগুয়েজের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, ইন্টারভিউয়ের সময় কখনো কাত হয়ে বসবেন না। সব সময় সোজা হয়ে বসুন।
ইন্টারভিউ কক্ষে ঢোকার আগে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিন। অ্যাড্রেনালিন আপনাকে যেমন সাফল্য এনে দিতে পারে, তেমনি ঘটাতে পারে সর্বনাশও। আপনি হয়তো সব ধরনের প্রস্তুতিই নিয়ে গেলেন, কিন্তু নার্ভাসনেসের কারণে ইন্টারভিউয়ের সময় সবকিছুই ভুলে গেলেন কিংবা এমনভাবে আপনার হাত ঘামতে শুরু করল যে বন্ধুদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক অনুশীলন করাটা কোনো কাজেই এল না। যদি আপনার ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে, তাহলে ইন্টারভিউ কক্ষে ঢোকার আগে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিন।
মনে মনে ছক কষে নিন ভেতরে গেলে কী করবেন। অ্যাড্রেনালিনকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে সেটা কিন্তু আপনাকে ভালো ইন্টারভিউ দিতে সাহায্যই করবে। বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে বলেন, ইন্টারভিউয়ের সময় ঘাবড়ে না গিয়ে আপনার প্রস্তুত করা উত্তরগুলোর দিকে মনোযোগ দিলে ইন্টারভিউ ভালো হয়।
ব্রিটিশ একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক ডার্মট রুনি বলেন, মুখোমুখি সাক্ষাৎকার আসলে একটি সুবর্ণ সুযোগ নিজেকে আরেকজনের কাছে তুলে ধরার। এখানে আপনি আরেকজনকে নিজের ব্যাপারে ভালো ধারণা দেওয়ার সুযোগ পান। আপনার ঝোঁক (প্যাশন) কোন দিকে, তা তুলে ধরতে পারেন।
তাই ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার আগে একবার ভাবুন, আপনার সবচেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য কোনটি? আপনার ব্যক্তিত্ব ও রুচি নিয়ে ভালো করে ভাবুন। ভেবে দেখুন, কোনো কোনো কারণে আপনি অন্যদের চেয়ে আলাদা। সেই সঙ্গে কাজের বিষয়ে জোর দিতে ভুলবেন না।
আপনি কেন কাজটি চান, আপনি কতটা পছন্দ করেন এ কাজ, এ কাজ পেলে আপনি কতটা উপকৃত হবেন—এ বিষয়গুলো বারবার বলবেন। আপনার এ কথাগুলো ইন্টারভিউয়ারের মতামতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ইন্টারভিউ শেষ না হওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়বেন না। প্রশ্ন শুনে যদি আপনার মনে হয় আপনি অথই সাগরে পড়েছেন, কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না, এ চাকরি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই আর নেই, তবু ঘাবড়ে যাবেন না। আপনার মনে হতেই পারে যে ভাইভা বা সাক্ষাৎকার যাঁরা নিচ্ছেন, তারা আপনাকে পছন্দ করছেন না, কিংবা এ কাজ পাওয়ার কোনো আশা নেই, তবু ভাইভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়বেন না।
কে জানে, হয়তো পরের প্রশ্নটির উত্তরই আপনি খুব ভালোভাবে দিতে পারবেন! তাই ঘাবড়ে না গিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সব প্রশ্ন মোকাবিলা করুন। দেখবেন চাকরিটা হয়তো আপনি পেয়েও গেছেন।