করোনার কারণে চাকরির বাজার থমকে গেছে। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই লোক নিয়োগ প্রায় বন্ধ। বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষাও স্থগিত হয়ে গেছে।
চাকরির খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সার্বিক কর্মসংস্থানে করোনা পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও কর্মসংস্থান সহজে আগের জায়গায় ফিরবে না। তবে দক্ষ তরুণদের জন্য চাকরির নতুন ক্ষেত্র বাড়বে বলে মনে করেন মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা।
৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা এ বছরের এপ্রিলের দিকে হওয়ার কথা ছিল। এতে অংশ নিতে আবেদন করেছেন ৪ লাখ ৭৫ হাজার প্রার্থী। করোনার কারণে ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলও স্থগিত রয়েছে। আটকে আছে ৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল। তবে ৩৯তম বিশেষ বিসিএসের সবার চাকরি হয়েছে।
জানতে চাইলে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, যেসব বিসিএসের ফল ও পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে, তা করোনাভাইরাসের কারণে। ৪১তম বিসিএসে প্রার্থী অনেক। এইচএসসি পরীক্ষার পর এই পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা ছিল। এইচএসসি পরীক্ষা নিয়েই তো এখন অনিশ্চয়তা। পরিস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সরকারি চাকরির অন্যতম বড় খাত ব্যাংক। এ খাতের নিয়োগ পরীক্ষাও আটকে আছে। নতুন করে কোনো নিয়োগ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পায়নি। জনতা ব্যাংকের অফিসার পদের একটি মৌখিক পরীক্ষা করোনার জন্য মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আর একটির প্রিলিমিনারি পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক আরিফ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে জনতা ব্যাংকের একটি নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। ওই পদের অধিকাংশ প্রার্থীর পরীক্ষা নেওয়া হলেও শেষ করা যায়নি। একই ব্যাংকের আরেকটি প্রিলিমিনারি পরীক্ষা মার্চের শেষ দিকে হওয়ার কথা থাকলেও শেষ সময়ে তা বন্ধ করতে হয়েছে। এই পরীক্ষায় ৬৩৩টি পদের বিপরীতে লক্ষাধিক প্রার্থী আবেদন করেন।
আরও অনেক নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল ডকুমেন্টেশন সেন্টারের (ব্যান্সডক) প্রথম শ্রেণির সায়েন্টিফিক অফিসার ও অ্যাকাউন্টস অফিসার পদের নিয়োগ পরীক্ষা। এটি গত ২০ মার্চ নির্ধারিত ছিল। ৩৫ পদের জন্য প্রার্থী ছিলেন ৫০ হাজার। একই দিনে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া তুলা উন্নয়ন বোর্ডের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ১১ ক্যাটাগরির পদে মোট ৪৫ পদের জন্য প্রার্থী ছিলেন ৩৫ হাজার এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগের স্বাস্থ্য পরীক্ষাও স্থগিত আছে। খাদ্য অধিদপ্তরের ১ হাজার ১০০ পদের আবেদনকারী ছিলেন ১৫ লাখ। মার্চ-এপ্রিলে এ পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা ছিল। এ পরীক্ষাও নিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। দুদকের বিভিন্ন পদের পরীক্ষাও আটকে আছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা কবে পরীক্ষা শুরু করতে পারবে, বুঝতে পারছে না।
নতুন চাকরির বিজ্ঞাপন নেই
সংবাদপত্র, চাকরির ওয়েব পোর্টাল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত তিন মাসে নতুন সরকারি চাকরির বড় কোনো বিজ্ঞপ্তি ছিল না। বরং করোনার কারণে পাঁচ ব্যাংকের কর্মকর্তা পদে আবেদনের মেয়াদ ১০ দিন বাড়ানো হয়েছে। বেসরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তিও কমে গেছে। সংবাদপত্রে সবচেয়ে বেশি চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু গত কয়েক মাসে এসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তি ছিল হাতে গোনা। শেষ এক মাসে এসব প্রতিষ্ঠান কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি।
দেশের চাকরির বড় ওয়েব পোর্টাল বিডি জবসের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত এপ্রিল ও মে মাসে আমাদের ওয়েব পোর্টালে প্রায় ৮০ শতাংশ বিজ্ঞাপন কম এসেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়োগপ্রক্রিয়া স্থগিত করেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান মৌখিক পরীক্ষার জন্য প্রার্থী বাছাই করেছিল, তারা সে প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে।’
চাকরির বাজার নিয়ে সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশে চাকরির বাজারে ধস নেমেছে। চাকরির বিজ্ঞাপন ব্যাপকভাবে কমেছে। গত বছরের মার্চের তুলনায় এ বছরের মার্চে চাকরির বিজ্ঞাপন ৩৫ শতাংশ কম ছিল। গত এপ্রিলে কমেছে ৮৭ শতাংশ। এপ্রিলে পোশাক ও শিক্ষা খাতে ৯৫ শতাংশ কম চাকরির বিজ্ঞাপন দেখা গেছে। উত্পাদনশিল্পে ৯২ শতাংশ কম চাকরির বিজ্ঞাপন এসেছে। স্বাস্থ্য খাতে চাকরি কমেছে ৮১ শতাংশ। তথ্যপ্রযুক্তিকে আগামীর সম্ভাবনা হিসেবে ধরা হয়, সেই খাতে চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে ৮২ শতাংশ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে ৬৪ শতাংশ।
বাড়ছে হতাশা
চাকরির নতুন বিজ্ঞাপন নেই বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগও প্রায় বন্ধ থাকায় হতাশ হয়ে পড়েছেন চাকরিপ্রত্যাশী তরুণেরা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন তাসনুভা আক্তার। তাঁর সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স শেষ হয় গত ১০ মে। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলো সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হবে, তাতে তিনি আবেদন করবেন। কিন্তু এখন নতুন কোনো চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত না হওয়ায় তিনিও হতাশ। এমন আরও অনেকের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে।
>শিক্ষার্থীদের উচিত এ সময়ে নিজেদের তৈরি করা। সরকারের উচিত উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে যাঁদের চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে, তাঁদের বিষয়টি নিয়ে তিনি সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
বাড়াতে হবে দক্ষতা
চাকরির বাজারের জন্য নিজেকে তৈরি করতে এই সময়টাকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা। রবি আজিয়াটা লিমিটেডের প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা ফয়সাল ইমতিয়াজ খান বলেন, নতুন চাকরির খোঁজে যাঁরা ব্যস্ত ছিলেন বা নতুন চাকরিতে প্রবেশ করার আশায় যেসব বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী চিন্তায় আছেন, তাঁদের জন্য এটাই সময় নিজেকে ইন্টারভিউর জন্য প্রস্তুত করা। নতুন সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আবির্ভূত হবে গেমিং, ডিজিটাল প্রোডাক্ট, গিগ ইকোনমি, মেন্টাল হেলথ, ইনস্যুরেন্স, অল্টারনেটিভ এনার্জি, অনলাইন কোচিং সেন্টার, ডেটা সায়েন্সসহ আরও অনেক কিছু। চাকরি না খুঁজে এই সময়গুলোর সদ্ব্যবহার করে উদ্যোক্তা হওয়া যায়।
এ পরিস্থিতিতে সরকার ও কর্মসংস্থান-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ইতিমধ্যে বেসরকারি ও কৃষি খাতে বেশ কিছু প্রণোদনা দিয়েছে। যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগুলো পেয়েছে, তাদের উচিত হবে এই টাকার সুষ্ঠু ও যথার্থ ব্যবহার করা। প্রণোদনার টাকার ব্যবহার ঠিকমতো করতে পারলে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হবে, তাতে কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কম পড়বে। এ ছাড়া সরকারের উচিত হবে আরও যেসব প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের খুঁজে বের করা। এসব খাতকে প্রণোদনা দিয়ে টেনে তুলতে হবে। তাহলে নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে।