চাকরিপ্রত্যাশী বেকারদের ভোগান্তির শেষ কোথায়

জীবনটাকে মাঝেমধ্যে বাস্তবতার সঙ্গে তুলনা করি। গোলমেলে জীবনটায় হিসাব মেলাতে বসে সবকিছু এলোমেলোই থেকে যায়। তা না হলে কি আর কয়েক শ মাইল পাড়ি দিয়ে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের জন্য সুদূর রাজধানীতে যেতে হয়। প্রায় এক যুগ আগে সেটাই ভাবতাম। আজকের সঙ্গে তখনকার সময়ের এটুকুই ফারাক। তখন ছিলাম বেকার, আজ আমি চাকরিজীবী। সময় গড়িয়েছে অনেক। সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছু বদলে গেলেও চাকরিপ্রত্যাশী বেকারত্বের কষ্ট ঘোচেনি।
আমার এক প্রতিভাবান বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় অবস্থানের জন্য সহজ একটি পদ্ধতি বেছে নেয়। এমফিল ডিগ্রি ভর্তি হওয়ার সুবাদে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ওঠে। ঢাকায় তাঁর অবস্থান পাকা হয়ে গেল। ঢাকায় থাকার মতো কোনো জায়গা ছিল না বলে তাঁর এমন দূরদর্শী কাজ! সেখানে অবস্থান করে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়াই তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, এমফিল ডিগ্রি নয়!

বর্তমানে ব্যাংক কিংবা অন্যান্য সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা ২ বা ৩ ধাপে হয়। পরীক্ষার সব ধাপই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। তবে মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত তিনবার ঢাকায় যাওয়া-আসা কতজনের পক্ষে সম্ভব, সেটাই বিবেচ্য। একবার মৌখিক পরীক্ষায় উপস্থিত হতে পারলেই যে চাকরি নিশ্চিত হয়ে যাবে, তা তো নয়। এমনও পরিচিত ব্যক্তি দেখেছি, যিনি কিনা ১৪তম মৌখিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে তবেই চাকরি নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। পরীক্ষার আবেদনে এবং ঢাকায় অবস্থান করতে কত টাকা বেকার ছেলেটিকে খরচ করতে হয়েছিল, তার হিসাব কে রাখে। তাঁর মতো এমন অনেকে আছেন, শুধু পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্যই যাঁদের হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। বেকার সময়ে এতগুলো টাকার জোগান দেওয়া অত্যন্ত কষ্টকর। বেকারত্বের এ কঠিন সময়ে অনেকে টিউশনি করে আবেদন এবং যাতায়াতের টাকা সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর অনেকেই টিউশনি করতে পারেনি। ফলে বেকারদের আরও সীমাহীন কষ্ট ও দুর্ভোগ বেড়ে যায়।

যেখানে বিসিএস প্রিলিমিনারিতে অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েক লক্ষ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু অন্য কোনো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় না কিংবা হওয়ার মতো কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ে না। যদি অন্যান্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে এ রকম উদ্যোগ নেওয়া হতো, তাহলে কয়েক লাখ বেকার তরুণ-তরুণী বারবার ঢাকায় যাওয়া থেকে রেহাই পেতেন। তাতে বেকারদের কষ্ট কমে আসত এবং অনেক টাকাও বেঁচে যেত।

বর্তমান সময়ে কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও সমান কর্মদক্ষতায় এগিয়ে চলেছেন। নারীদের অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এসব চাকরিপ্রত্যাশী বেশির ভাগ তরুণী নিজ জেলায় অবস্থান করেন। তাই পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ে প্রতিবার ঢাকায় যাওয়া-আসা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। তা ছাড়া সার্বিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেকেই রাজধানীকেন্দ্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে চান না। তাই ইচ্ছা থাকলেও অনেকে পরীক্ষায় বসতে চান না। ফলে নারীরা চাকরিক্ষেত্রে প্রবেশে চরম বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। অথচ এ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা রাজধানীকেন্দ্রিক না হয়ে অন্তত বিভাগীয় শহরে অনুষ্ঠিত হলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পথ সুগম হতো। নারীদের সামনে যাওয়ার পথ আরও প্রসারিত হতো। অথচ তা তিমিরেই থেকে যায়।

করোনাকালে চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের হতাশা বহুগুণ বেড়ে যায়। আশা ছিল, করোনা থেমে গেলে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। কিন্তু সেটাও আর হলো না। একদিকে চাকরি পেতে প্রাণপণ চেষ্টা, অন্যদিকে আবেদনকারী সব বাছাই পরীক্ষায় বসতে না পারা। সব মিলিয়ে হতাশা আরও বাড়তে থাকে।

করোনার সংক্রমণ কমে আসায় একে একে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হতে থাকে। সে হিসেবে গত কয়েক শুক্রবারে একই সময়ে অনেক পরীক্ষা হওয়ায় চাকরিপ্রার্থীরা মাত্র একটি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন। ফলে চাকরি পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে আসে। অথচ সব পরীক্ষায় অংশগ্রহণের নিমিত্তেই চাকরিপ্রার্থীরা আবেদন করেন। প্রতিটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের নিমিত্তে প্রত্যেককে আলাদাভাবে নির্ধারিত ফির মাধ্যমে আবেদন করতে হয়েছে। প্রতিটি আবেদনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা প্রয়োজন পড়ে। বাস্তবে অনেকগুলো পরীক্ষায় আবেদন করা বেকারদের সাধ্যের বাইরে। তাই ধারদেনা করে হলেও আবেদন সম্পন্ন করে। পছন্দের একাধিক পদে আবেদন করা সত্ত্বেও একটি পরীক্ষা দিয়ে আত্মতৃপ্ত থাকতে হচ্ছে। আবেদন করা সত্ত্বেও যাঁরা পরীক্ষায় বসতে পারছেন না, তাঁদের হতাশার সঙ্গে মানসিক যাতনা তাড়া করছে। যেখানে সাধারণ ছাত্র থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি মেধাবী ছাত্রটিও চাকরির আশায় দিন গুনছেন, সেখানে এক দিনে এতগুলো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া কতটুকু সমীচীন, সেটাই বিবেচ্য। উল্লেখ্য, গত ১৭ সেপ্টেম্বরে একই দিনে ২১টি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়!

একই দিনে এতগুলো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে মেধাবীদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে। কারণ, সবাই সব পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভালো মানের চাকরির প্রত্যাশা করেন। তাই অপেক্ষাকৃত ভালো পদের বিপরীতে অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থী বেড়ে যায়। আবার যেসব চাকরির বিজ্ঞাপনে শূন্য পদের সংখ্যা বেশি, সেসব পদের বিপরীতে স্বাভাবিকভাবে পরীক্ষার্থী বেড়ে যাবে।

বাকিগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। একসঙ্গে অনেক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় সমন্বয়ের অভাবে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। ফলে মেধাবীরা ভালো চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ফলে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যে প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা, আদৌ তা হবে না। ফলে কোনো কোনো পরীক্ষায় উপস্থিত প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাবে, আবার কোনো কোনোটিতে উপস্থিত প্রার্থীর সংখ্যা কমে যাবে। তাতে অনেক মেধাবী ছাত্র প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়বে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা চাকরির স্থান দখল করে রাখবে। এভাবে চলতে থাকলে চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ-তরুণীদের হতাশায় গ্রাস করবে, যদিও আমাদের তরুণ-তরুণীরা শত প্রতিকূলতাকে পেরিয়ে এগিয়ে চলে।

তাই চাকরি প্রার্থীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে ইতিমধ্যে পিএসসি শুক্রবারে পরীক্ষা না নেওয়ার কথা ঘোষণা প্রদান করে, যা এ মুহূর্তে একটি ভালো উদ্যোগ বলা চলে। অন্য সব চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান সুন্দর ও অভিনব এ পন্থা অবলম্বন করলে চাকরিপ্রত্যাশীরা আরও স্বস্তি পেত। তবে বিসিএসের ৪৩তম প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ২৯ অক্টোবর পূর্বনির্ধারিত হয়ে থাকলেও ওই দিন আরও কয়েকটি পরীক্ষা নির্ধারণ করা হয়। বলা বাহুল্য, এসব পরীক্ষার সমন্বয়হীনতার অভাবে বেকার তরুণ-তরুণীদের সমস্যা নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এ সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে না। ফলে চাকরিপ্রত্যাশী বেকারদের ভোগান্তি বাড়ছে বৈ কমছে না।


*লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংকার