একই দিনে একাধিক চাকরির পরীক্ষা, ভুক্তভোগীর খোঁজ কেউ রাখে না

 প্রথম আলো ফাইল ছবি

অনেক দিন ধরেই ভাবছি বিষয়টি নিয়ে কিছু লিখি। অপেক্ষা করছিলাম বিশেষজ্ঞদের লেখা পড়ার। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সবার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ কেউ এসব নিয়ে লিখছে না, ভাবছেও না। অবশ্য যার ঘা, তার ব্যথা। বড় বড় মানুষের এসব ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ভাবার সময় কই! যার ঘা তার কথা কেউ শুনছে না, আর যার কথা লোকে শোনে, সে এসব বলছে না!

সোনিয়া জামানের স্বামী আসাদুজ্জামান পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মিটার টেস্টার পদে নিয়োগ পরীক্ষা দিচ্ছেন। তিনিও প্রস্তুতি নিচ্ছেন পিএসসির চাকরির জন্য। ঘণ্টাব্যাপী পরীক্ষার সময়ে বাইরে বসে পড়াশোনা করছেন তিনি। মিরপুর গার্লস আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা, ১৭ সেপ্টেম্বর

চাকরির পত্রিকার পাশাপাশি জাতীয় দৈনিকগুলোতেও এখন চাকরির খবর ছাপানোর জন্য আলাদা পাতা থাকে। সেখানে ছাপা হয় বড় করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির খবর। সরকারি-বেসরকারি সব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির খবর পত্রিকার পাতা ওলটালেই পাওয়া যায়। দেখে মনে হবে এত চাকরি চারপাশে, তবে এত বেকার কেন? প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক জনমনে।

অথচ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপ অনুযায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকে। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পায়। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রও ভিন্ন কিছু হবে না! এই বেকারত্বের হিসাবটিই কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিক প্রকাশ করেছিল। ফলাফল তেমন দেখা যায়নি। আরও দুঃখের বিষয় হলো, এ প্রতিবেদন নীতিনির্ধারকদের টনক নড়াতে পারেনি।

সবাই যেন ফাটাকেষ্ট হতে চায়! এরা খবর পড়ে না, খবর দেখে না, খবর শোনেও না! এরা খবর তৈরি করে! ফলাফল দেখা যায়নি বা টনক নড়েনি কথাটা বললাম এ জন্য যে এর সমাধান নিয়ে কেউ কখনো ভেবেছে কি না, আমার জানা নেই। যদি ভাবত, তবে সমাধান নিশ্চয়ই কিছু আসত।

পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ যখন স্বপ্ন দেখে ভালো কোনো চাকরি তার জীবনের গতি পাল্টে দেবে, তখন দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় নীতিনির্ধারকেরা। তা–ই যদি না হবে, তবে একই দিনে ২১টি (১৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত) পরীক্ষা দেওয়ার কারণ কী হতে পারে?
করোনা সংক্রমণের পর দীর্ঘ দুই বছর অপেক্ষায় থেকে যখন নিয়োগ পরীক্ষা চালু হয়েছে, তখন একই দিনে ২১টি পরীক্ষা দেওয়ার যুক্তিটা জানার অধিকার আছে একজন চাকরিপ্রার্থী হিসেবে। এমন ঘটনা যে এটাই প্রথম, তা নয়। এটা ঘটনার পুনরাবৃত্তি! এমন তামাশা হরহামেশাই হয়ে থাকে।

অন্যদিকে, অনেক নিয়োগ পরীক্ষা শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে দেওয়া হয়। শুক্রবার না দিয়ে সপ্তাহের অন্য দিন দেওয়ার কারণও জানতে চায় চাকরিপ্রার্থীরা। আবেদন ফি নিয়ে নাই–বা বললাম। ফি তো গলাকাটা! তার ওপর নিয়োগ পরীক্ষা সব রাজধানীকেন্দ্রিক। এই শহরে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য যাঁরা অন্যান্য পেশায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন, পাশাপাশি পড়াশোনা করে একটি সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখেছেন, তাঁদের নিয়ে রীতিমতো যেন তামাশা করছেন নীতিনির্ধারকেরা। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, বেসরকারি সেক্টরে এত সুযোগ থাকতে কেন শুধু সরকারি চাকরিই খুঁজছে সবাই? এর উত্তরটা পাঠকই দেবে।

সরকারি চাকরি যেন কলা দেখিয়ে মুলা খাওয়ানোর মতো! একটি পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে কত কষ্ট হয় তা জানেন নীতিনির্ধারকেরা? নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করছেন, লাখ টাকা জমা হচ্ছে হিসাবে! তারপর একই দিনে সব পরীক্ষার তারিখ দিয়ে আবেদনকারীকে বঞ্চিত করছেন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে, স্বপ্ন নষ্ট করছেন! এর জবাব কার কাছে চাইবেন চাকরিপ্রার্থীরা? কে শুনছে এসব নিরীহ চাকরিপ্রার্থীর কথা?
জবাবদিহির জায়গাটা অনেক আগেই হয়তো হারিয়ে গেছে! নইলে একটা নিয়োগসংক্রান্ত স্বচ্ছ ও জবাবদিহি কমিটি থাকত! কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কিছুই বোধ হয় করার নেই এদের। যদি নিজের অধিকার আদায়ে রাস্তায় দাঁড়ায়, তখন পুলিশের লাঠিপেটা ছাড়া আর কিছই জুটবে না, এটা চাকরিপ্রার্থীর একটা বড় অংশ ভালোভাবেই জানে।

সব চাকরিপ্রার্থীর চাওয়া একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহি নিয়োগসংক্রান্ত কমিটি। একটি কমিটি থাকবে যার অধীনে সব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আসবে ও পরীক্ষা হবে। এতেই হয়তো ভুক্তভোগী আবেদনকারীদের মুক্তি মিলতে পারে। দীর্ঘদিন ধরেই শুনছি এ দায়িত্ব কোনো একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হবে। তবে তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি। কেউ কোনো দিন হয়তো ভাবেইনি এসব নিয়ে!

লেখক: তাছনিয়া তাবাচ্ছুম, সাবেক শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ