করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর সরকারি চাকরির বড় নিয়োগের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। চাকরিপ্রার্থীরা আশা করেছিলেন ২০২২ সালে বেশি করে বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আসবে। কিন্তু বছরজুড়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তেমন বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখা যায়নি। তবে গত দুই বছরে আটকে থাকা কয়েকটি বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ ও পদায়ন করা হয়েছে ২০২২ সালে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, করোনা মহামারির কারণে কয়েকবার মৌখিক পরীক্ষা পেছানো
৪০তম বিসিএসে উত্তীর্ণ বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৯২৯ জনকে ডিসেম্বরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ৩৭ হাজার ৫৭৪ জন প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁরা নিয়োগের অপেক্ষায় আছেন। এ দুটি বাদে বড় কোনো নিয়োগ কার্যক্রম শেষ হয়নি।
আকর্ষণীয় বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কারণে তরুণ-তরুণীদের কাছে পছন্দের শীর্ষে বিসিএস। বিদায়ী বছরে নতুন একটি মাত্র বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। সেটিও বছরের শেষে গত নভেম্বরে। ৩০ নভেম্বর সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) ওয়েবসাইটে এই বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এই বিসিএসে ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডার পদের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো নন-ক্যাডার পদের সংখ্যা উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পিএসসি। ক্যাডার পদে যেমন পছন্দ নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়, তেমনই নন-ক্যাডার পদেও পছন্দের তালিকা নির্দিষ্ট করে দিতে পারবেন প্রার্থীরা।
এ ছাড়া বিদায়ী বছরে একটি বিসিএসের নিয়োগ কার্যক্রম শেষ হয়েছে। ১ নভেম্বর ৪০তম বিসিএসের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে ১ হাজার ৯২৯ জন বিভিন্ন ক্যাডারে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে তাঁরা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। ২০১৮ সালে এই বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রায় চার বছর পর নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা চাকরিপ্রার্থী আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, একটি বিসিএসের নিয়োগ কার্যক্রম শেষ করতে তিন থেকে চার বছর সময় লেগে যায়। অথচ পিএসসি থেকে বারবার বলা হয় এক বছরেই একটি বিসিএসের নিয়োগ কার্যক্রম শেষ করা হবে। যেহেতু একটি বিসিএস শেষ করতে অনেক সময় লাগে তাই বছরে একাধিক বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা উচিত।
বিসিএসের পর তরুণদের কাছে ব্যাংকের চাকরি বেশ জনপ্রিয়। আগে সরকারি ব্যাংকগুলো আলাদা আলাদাভাবে নিয়োগ দিত। সেখানে একই প্রার্থী বিভিন্ন ব্যাংকে আবেদন করতে পারতেন। তরুণদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে সব ব্যাংকে নিয়োগ সহজ করতে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি গঠন করা হয়। এর সদস্যভুক্ত আটটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে অফিসার (ক্যাশ), সাধারণ অফিসার, সাধারণ সিনিয়র অফিসার, সিনিয়র অফিসার (আইটি) ও অফিসার রুরাল ক্রেডিট (আরসি) পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এসব পদে ৫ হাজার ৮৬ জন নিয়োগের জন্য সবশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। এটি ছিল ২০২০ সাল ভিত্তিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। এসব পদে নিয়োগের জন্য এখনো কোনো পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। এ ছাড়া নতুন বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা চাকরিপ্রার্থী মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বিদায়ী বছরে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত আটটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নতুন কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই। যেগুলো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো ২০২০ ও ২০২১ সাল ভিত্তিক।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রমের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ৩৭ হাজার ৫৭৪ জনকে প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করে গত ১৪ ডিসেম্বর ফলাফল প্রকাশ করা হয়। পুলিশ ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে তাঁরা জানুয়ারি মাসে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানের আশা করছেন। প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের জন্য ২০২০ সালে এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। করোনা মহামারির কারণে এর নিয়োগ কার্যক্রম আটকে ছিল। প্রায় দুই বছর পর নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় চাকরিপ্রার্থীরা আশা খুঁজে পান।
সহকারী শিক্ষক হিসেবে প্রাথমিকে সুপারিশ পাওয়া আইরিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই নিয়োগের মাধ্যমে ৩৭ হাজার বেকারের পরিবারে হাসি ফুটেছে। বিশেষ করে আমার মতো যাঁদের চাকরির বয়স শেষ, তাঁদের জন্য বিদায়ী বছরে এটা ছিল সেরা উপহার। প্রাথমিকে শিক্ষকের ঘাটতি পূরণ করতেও এ নিয়োগ কিছুটা সুফল দেবে। তবে প্রাথমিকে শূন্য পদ বেশি থাকায় নতুন বছরে নতুন আরেকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রয়োজন।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে ২০২২ সালে তিনটি নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদে দুটি ও সার্জেন্ট পদে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে চার হাজার কনস্টেবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। এরপর আবার ৫ হাজার ৫০০ জন কনস্টেবল নিয়োগের জন্য ডিসেম্বরে আরেকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এটির নিয়োগ কার্যক্রম এখনো চলছে। নভেম্বরে পুলিশের সার্জেন্ট পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।
এ পদেও নিয়োগ কার্যক্রম চলমান। এ ছাড়া ২০২১ সালে এসআই পদে যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল সেটির নিয়োগ কার্যক্রম ২০২২ সালে শেষ হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে এসআই পদে নিয়োগ পান ৮১৫ প্রার্থী।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সরকারের অন্যতম বড় নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান। গত জুনে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সংসদ সদস্য মামুনুর রশীদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন, রেলওয়ের শূন্য পদের সংখ্যা ২২ হাজার ৭০৪। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির পদ ২০১টি, দ্বিতীয় শ্রেণির ১ হাজার ৬০১টি, তৃতীয় শ্রেণির ৮ হাজার ৫৭৫টি এবং চতুর্থ শ্রেণির ১২ হাজার ৩২৭টি। কিন্তু এর মধ্যে শুধু ৩টি পদে ২ হাজার ৪০৮ জন নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর মধ্যে রয়েছে সহকারী স্টেশনমাস্টার পদে ৫৬০ জন, পয়েন্টসম্যান পদে ৭৬২ জন ও খালাসি পদে ১ হাজার ৮৬ জন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি। এর মধ্যে শুধু সহকারী স্টেশনমাস্টার ও পয়েন্টসম্যান পদের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়েছে। বাকি পদের নিয়োগ কার্যক্রম এখনো চলমান।
অনলাইনে চাকরি খোঁজার প্রতিষ্ঠান বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে, করোনার দুই বছরের ধাক্কা কাটিয়ে ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাস বেসরকারি চাকরির বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অক্টোবর থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োগ কমিয়ে দেয়। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় নিয়োগ নেই বললেই চলে।
এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘আমরা শুধু বড় বড় কোম্পানিগুলোর ছাঁটাইয়ের কথা শুনি। অথচ অনেক ছোট ছোট কোম্পানিও কর্মী ছাঁটাই করছে। এ রকম ছাঁটাই চাকরির বাজরের জন্য শুভকর নয়।’