দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আবিদ হোসেন ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও চাকরি পাননি। অথচ তখন বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস এবং অন্যান্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ ছিল। আবিদ হোসেনসহ মোট ৫ জন প্রতিবন্ধী প্রার্থী এ নিয়ে ২০১৫ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন।
এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ১৬ নভেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। পরে ২০১৭ সালের ২৯ অক্টোবর ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৫ জন প্রতিবন্ধী প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি এ কে এম সাহিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই ৫ প্রার্থীর করা রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আবিদ হোসেনসহ রিটকারী পাঁচজন রায়ের অনুলিপি হাতে পেয়েছেন চলতি বছরের ২০ আগস্ট। এর মধ্যে পার হয়েছে ছয় বছর। এ রায়ের অনুলিপি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কার্যালয়ে পৌঁছেছে আগস্ট মাসেই। ওই ৫ জনকে আদালতের রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে এই পাঁচজন এখনো কোথাও নিয়োগ পাননি। এ বিষয়ে কোনো তথ্যও জানতে পারেননি। ফলে একবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং আরেকবার পিএসসিতে দৌড়াচ্ছেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছে পিএসসি।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ২০১৩ সালে ৩৪তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ২০১৪ সালে পরীক্ষা এবং ২০১৫ সালে পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হয়।
গত মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে আবিদ হোসেন আক্ষেপ করে বলন, ‘আদালতের রায় আমাদের পক্ষে আছে। তবে এ রায়ের অনুলিপি পেতেই লেগে গেল ছয় বছর। অনুলিপি হাতে পাওয়ার পরও তিন মাস পার হলো, কিন্তু কোনো তথ্যই জানতে পারছি না।’
৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অন্য চার আবেদনকারী হলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী মীর মো. মোশাররফ হোসেন, এস এম জাহিদুল ইসলাম, এনায়েত কবির ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বাবুল চন্দ্র দাস।
আবিদ হোসেন ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ও গবেষণায় এমএড করেন। বর্তমানে তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরের জাতীয় বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্রের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য পরিচালিত বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। জানালেন, তিনি যে বেতন পান, তা দিয়ে স্ত্রী স্টেলিকা দাড়িং ও সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী সন্তান নিয়ে ঢাকায় বসবাস করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরি করবেন, এটা তাঁর স্বপ্ন ছিল। এর মধ্যে সরকারি চাকরির (প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ৩২ বছর) বয়সটাও শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হচ্ছে না।
১৯৯০ সালে আবিদ হোসেন খেলতে গিয়ে চোখে ব্যথা পেয়েছিলেন। পরে হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় হাসপাতালে পিছলে পড়ে গিয়ে ওই চোখেই আবার আঘাত পান। আর এক চোখে আগে থেকেই কম দেখতেন। ছোটবেলা থেকেই দুই চোখে কিছু দেখেন না তিনি।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বাবুল চন্দ্র দাস চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় প্রায় ৩০ বছর আগে দুই চোখের দৃষ্টি হারিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ করা বাবুল চন্দ্র দাস বর্তমানে কুমিল্লায় সোনালী ব্যাংকে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। মা ও স্ত্রীকে নিয়ে তিনি কুমিল্লায় থাকেন। তিনিও বললেন, তাঁদের অপেক্ষার পালা আর শেষ হচ্ছে না।
শারীরিক প্রতিবন্ধী এনায়েত কবির মেরুদণ্ডের সমস্যায় একা খুব বেশি দূর হেঁটে যেতে পারেন না। সাভারে জনতা ব্যাংকে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কর্মরত এনায়েত কবিরের সন্তানের বয়স ১১ মাস। তিনি বলেন, ‘আমি একা বা আমরা সবাই মিলে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। তবে আস্তে আস্তে হতাশ হয়ে পড়ি। আমি ব্যক্তিগতভাবে দৌড়ঝাঁপ কমিয়ে দিই। রায়ের অনুলিপি পেতেই তো লেগে গেল ছয় বছর। এরপর সরকারপক্ষ আপিল করলে আবার কত বছরের ধাক্কা, তা তো বলা যাচ্ছে না। তাই যদি কোনো ইতিবাচক ফলাফল পাইও তত দিনে দেখা যাবে, আমার আর সেই চাকরি করা সম্ভব হবে না।’ এনায়েত কবির জাহাঙ্গীরনগর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেছেন।
এস এম জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে এমএ করেছেন। তাঁর পায়ে সমস্যা আছে। সরকারি একটি সংস্থায় কাজ করছেন তিনি। পেশাগত কারণে তিনি তাঁর বিভিন্ন তথ্য ও ছবি প্রকাশ করতে চান না বলে জানিয়েছেন।
মীর মো. মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকতা করলেও আপাতত বেকার। রিটকারীদের পক্ষে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। পোলিওর জন্য শারীরিক জটিলতা দেখা দেয় তাঁর। স্ত্রী চাকরি করায় সন্তান নিয়ে সংসার চলছে।
মীর মো. মোশাররফ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিকস থেকে এমএসসি করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিসিএসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য যে সার্কুলার ছিল, সেটাও এমনভাবে করা হয়েছিল, যাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা চাকরিই না পান। সেই বিভ্রান্তি কাটাতে আমরা আদালতের কাছে যাই। হাইকোর্টের রায় পক্ষে আসার অর্থ হচ্ছে আমরা যৌক্তিক অবস্থানে আছি। আপিল হলে তাতেও আমরাই বিজয়ী হব। কিন্তু ভয় হচ্ছে বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে। আমাদের ইচ্ছা ছিল, কাজ করে এটা প্রমাণ করা যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা শত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে দায়িত্ব পালনে সক্ষম। কিন্তু এখন সন্দিহান হয়ে পড়ছি। অবশ্য শেষ না দেখে আমরা থামছি না।’
আদালতের রায়ে ২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ‘বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস এবং অন্যান্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ’–সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ‘খ’ অংশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এ অংশে বলা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটার মধ্যে যে কোটায় পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাবে না, সেই কোটার ১ শতাংশ যোগ্য প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করা হবে।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে পিএসসি
পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন রায়ের অনুলিপিসহ সব নথিপত্র দেখে প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩৪তম বিসিএসে প্রতিবন্ধী কোটা ছিল। কোটায় তিনজনকে সুপারিশ করা হয়েছিল। এই পাঁচজন সুপারিশপ্রাপ্ত হননি। ক্যাডারের ক্ষেত্রে বলা ছিল, যদি প্রতিবন্ধী কোটায় সবাইকে সুপারিশ না করা যায়, তাহলে অন্য কোনো কোটায় শূন্য পদ থাকলে সেখান থেকে ১ শতাংশ এনে প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের সুপারিশ করা যাবে। আর নন-ক্যাডারে তাঁরা মেধায় আসেননি। রায়ে কোটা বাড়িয়ে এবং ৬০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার, পিএসসির নয়। মন্ত্রণালয় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে। আমাদের যে সীমাবদ্ধতা আছে এবং আইনগতভাবে কিছু করার নেই, তা জানিয়ে আমরা এখন আপিল করব।’