ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বসে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে উঠেছেন মো. রাশেদুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে ফজরের নামাজ শেষে গ্রন্থাগারে ঢোকার জন্য লাইনে ব্যাগ রাখতে এসে দেখেন, তাঁর সিরিয়াল নম্বর ১৪২।
মো. রাশেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাইব্রেরিতে ঢুকতে ব্যাগ রাখার লাইন শুরু হয় মূলত রাত ১২টায়। তাই ভোরে এসেও আমি পেছনে। আগে ব্যাগ রেখে না গেলে লাইব্রেরিতে সিট পাওয়া যায় না। তাই কেউ কেউ ঘুমানোর আগে রাত ১২টা-১টার দিকে লাইনে ব্যাগ রেখে যান। আমি তিন থেকে চার মাস ধরে প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর লাইনে ব্যাগ রেখে যাই। সকাল আটটায় যখন লাইব্রেরি খোলে, তখন এই ব্যাগের সিরিয়াল অনুযায়ী লাইব্রেরিতে প্রবেশ করি।’
আজ বুধবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রন্থাগারে ঢোকার লাইনে ব্যাগ রেখে পাশে বই নিয়ে পড়ছেন কয়েকজন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সামনে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। এ জন্য লাইব্রেরিতে চাকরিপ্রার্থীদের ভিড় আগের চেয়ে বেশি। তবে সারা বছরই এখানে চাকরিপ্রার্থীরা বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির প্রস্তুতি নিতে পড়তে আসেন।
গ্রন্থাগারে পড়তে আসা জুনায়েদ আহমেদ নামের এক চাকরিপ্রার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসায় পড়তে পড়তে ঘুমাতে মন চায়। তাই একটানা পড়া হয় না। কিন্তু লাইব্রেরিতে এলে যতই ক্লান্ত লাগুক, পড়া চালিতে যেতে হয়। কারণ, ঘুমাতে মন চাইলেও লাইব্রেরিতে ঘুমানোর জায়গা নেই। লাইব্রেরিতে দুপুরের খাওয়া আর মাঝেমধ্যে চা খাওয়ার বিরতি ছাড়া দীর্ঘক্ষণ পড়া যায়। তাই এখানে পড়তে আসি। এ ছাড়া অনেক চাকরিপ্রার্থীর প্রস্তুতি নেওয়া দেখে নিজেরও উৎসাহ বাড়ে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে যাঁরা পড়তে এসেছেন, তাঁদের সবার হাতে বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির প্রস্তুতির বই দেখা যায়। কেউবা মুঠোফোনে নোট করছেন, কেউ আবার খাতায় লিখছেন।
লাইব্রেরিতে এলে যতই ক্লান্ত লাগুক, পড়া চালিতে যেতে হয়। কারণ, ঘুমাতে মন চাইলেও লাইব্রেরিতে ঘুমানোর জায়গা নেই। লাইব্রেরিতে দুপুরের খাওয়া আর মাঝেমধ্যে চা খাওয়ার বিরতি ছাড়া দীর্ঘক্ষণ পড়া যায়। তাই এখানে পড়তে আসি। এ ছাড়া অনেক চাকরিপ্রার্থীর প্রস্তুতি নেওয়া দেখে নিজেরও উৎসাহ বাড়ে।জুনায়েদ আহমেদ, চাকরিপ্রার্থী
সরকারি চাকরির প্রস্তুতির বই ছাড়া অন্য বই কেউ পড়তে আসেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে নূর আলম নামের এক চাকরিপ্রার্থী বলেন, এখন পর্যন্ত কাউকে গল্পের বই পড়তে দেখেননি। তবে চাকরির প্রস্তুতির পাশাপাশি কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে আসেন।
পাঁচ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে চাকরির প্রস্তুতি নিতে আসেন মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মতো অনেকে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষ থেকে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। বেসরকারি চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই এখন সবার একটাই লক্ষ্য, যেকোনো মূল্যে সরকারি চাকরি পেতে হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের রিডিংরুমে না পড়ে গ্রন্থাগারে সবাই পড়তে আসেন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে পড়তে আসার অন্যতম কারণ, এখানে এসি আছে। হলের রিডিংরুমগুলোতে অতিরিক্ত গরমের কারণে থাকা যায় না। তাই প্রায় সবাই গ্রন্থাগারে পড়তে আসেন। গরমের কারণেও গ্রন্থাগারে চাকরিপ্রার্থীদের ভিড় বেড়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গ্রন্থাগারে এখন যাঁরা পড়তে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিসিএস প্রার্থী। পড়তে আসা গবেষকের সংখ্যা খুবই কম। এই গ্রন্থাগারের ধারণক্ষমতা ১ হাজার ৫০০ জনের। তবে একসঙ্গে দুই হাজার জন পড়তে পারেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুর বলেন, ‘আমাদের উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি রয়েছে। যে কারণে শিক্ষার্থীরা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। একই সঙ্গে চাকরির বাজার সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তাই জব সল্যুশন বা চাকরির গাইডজাতীয় বই পড়তে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।’
এ অবস্থার সমালোচনা করে তারিক মনজুর বলেন, এর পরিবর্তন জরুরি। লাইব্রেরিতে বাইরে থেকে আনা বই পড়ার সুযোগ বন্ধ করা উচিত। একই সঙ্গে চাকরির পরীক্ষায় এমন প্রশ্ন রাখা ঠিক নয়, যা মুখস্থ থাকলেই পারা যায়। চাকরির পরীক্ষা কোনোভাবেই প্রার্থীর স্মরণশক্তি যাচাইয়ের পরীক্ষা হতে পারে না; বরং এ ধরনের প্রশ্নে প্রার্থীয় বিশ্লেষণ-দক্ষতা যাচাই করতে হবে।