বর্তমানে চাকরিপ্রার্থীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। সিভিল সার্ভিসের সাধারণ ও কারিগরি/পেশাগত—২ ক্যাটাগরিতে মোট ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। প্রতিটি ক্যাডারের দায়িত্ব ও কাজ, পদায়ন ও প্রশিক্ষণ, বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত প্রকাশ করা হচ্ছে চাকরি-বাকরি পাতায়। আজ অষ্টম পর্বে থাকছে বিসিএস আনসার ক্যাডারের দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধা। বিস্তারিত জানাচ্ছেন ৩৫তম বিসিএস কর্মকর্তা রবিউল আলম লুইপা
১৯৪৮ সালে আনসার প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য আনসার বাহিনী প্রথম আলোচনায় আসে। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনী ৪০ হাজার থ্রি নট থ্রি ক্যালিবার রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করে, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান প্রতিরোধের অস্ত্রশক্তি। মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে ১২ জন আনসার সদস্য বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারকে গার্ড অব অনার দেন।
বিসিএস আনসার ক্যাডার পরিচালিত হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন, পদোন্নতি ও বদলি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ১৯৭৬ সালে ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি (ভিডিপি) গঠিত হলে পরবর্তী সময়ে আনসারের সঙ্গে ভিডিপিকে যুক্ত করা হয়। অন্যান্য বাহিনীর মতো আনসার ও ভিডিপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আনসার ও ভিডিপির বর্তমান সদর দপ্তর খিলগাঁও। বিভিন্ন সরকারি ও সিভিল স্থাপনার (কেপিআই) নিরাপত্তা, পূজা, নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন, পুলিশকে সহায়তা ও বিভাগীয় শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি।
জেলা, সদর দপ্তর, প্রশিক্ষণ একাডেমি, ৪২টি ব্যাটালিয়নে; এমনকি র্যাব, এসএসএফ, এভিয়েশন সিকিউরিটিতেও ডেপুটেশনে পদায়ন হতে পারে। জেলা ও ব্যাটালিয়নে ক্যাডারের পদসোপান হলো সহকারী জেলা কমান্ড্যান্ট/কোম্পানি কমান্ডার, জেলা কমান্ড্যান্ট/ব্যাটালিয়ন উপ-অধিনায়ক, ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক। সদর দপ্তর ও প্রশিক্ষণ একাডেমিতে ক্যাডারের পদসোপান হলো সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, পরিচালক, উপমহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, মহাপরিচালক। বাহিনী প্রধান হিসেবে মহাপরিচালক, একাডেমি প্রধান কমান্ড্যান্ট (অতিরিক্ত মহাপরিচালক পদমর্যাদা), আনসারের জোন প্রধান হিসেবে উপপরিচালক, জেলা প্রধান হিসেবে জেলা কমান্ড্যান্ট, ব্যাটালিয়ন প্রধান হিসেবে অধিনায়ক দায়িত্ব পালন করে থাকেন। একজন মেজর জেনারেল সর্বোচ্চ পদ মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
যোগদানের পর আনসার ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা অন্য ক্যাডারদের সঙ্গে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (বিপিএটিসি) ছয় মাস মেয়াদি বনিয়াদি প্রশিক্ষণ (ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কোর্স—এফটিসি) সম্পন্ন করেন। এরপর আনসার একাডেমি, সফিপুর, গাজীপুরে এক বছর মেয়াদি মৌলিক প্রশিক্ষণ নেন। তিন মাস প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে পাসিং আউট অনুষ্ঠানে প্যারেড করতে হয়, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ইন হিউম্যান সিকিউরিটি সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। এ ছাড়া অফিস ব্যবস্থাপনা, ই-ফাইলিং, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, প্রকিউরমেন্ট, বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো দেশের ভেতরে ও সাইবার ট্রেনিং, কমান্ডো ট্রেনিংয়ে তুরস্ক ও অন্য দেশে প্রশিক্ষণ নিতে হতে পারে। অন্য ক্যাডারের মতো সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিভিন্ন দেশে মাস্টার্স এবং পিএইচডি করার সুযোগ তো আছেই।
সরকারি বেতন স্কেল-২০১৫ অনুসারে সব ক্যাডারের কর্মকর্তা ২২ হাজার টাকা মূল বেতনে চাকরিজীবন শুরু করেন। যোগদানের সময় একটি অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট পাওয়ার পর মূল বেতন হয় ২৩ হাজার ১০০ টাকা। মূল বেতনের নির্দিষ্ট হারে বাড়ি ভাড়া (জেলা শহরে ৪০%, অন্যান্য বিভাগে ৪৫%, ঢাকা বিভাগে ৫০%), ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, সন্তানের জন্য শিক্ষা সহায়ক ভাতা, ঈদ/পূজাতে উৎসব ভাতা, বৈশাখে নববর্ষ ভাতা, সরকারি দায়িত্ব ও যাতায়াতের জন্য টিএ/ডিএ ভাতাসহ সরকারি সব আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর বাইরে আনসার প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত সেমিনারে প্রশিক্ষণ সম্মানী পাওয়ার সুযোগ আছে।
আনসারের মূল ইউনিফর্ম জলপাই রঙের; এ ছাড়া ব্যাটালিয়নে থাকাকালে কমব্যাট ইউনিফর্ম পরতে হয়। অন্যান্য ইউনিফর্ম চাকরির মতো আনসার ও ভিডিপিও সম্মানের চাকরি। যেখানে যাবেন, প্রচুর পরিমাণে লজিস্টিকস সাপোর্ট পাবেন। আপনি ব্যাংক, হাসপাতাল, জাদুঘর—যেখানেই যান, সেখানেই আনসার সদস্য পাবেন, যাঁরা আপনাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত। পদোন্নতিও ভালো। অন্য ২৫ ক্যাডারের মতো ২৫% পুল কোটায় সরকারের উপসচিব হওয়ার সুযোগ আছে। কর্মকর্তার সংখ্যা কম থাকায় অনেকেই ডিএস পুলে উপসচিব হয়ে থাকেন।
রেশন (চাল, গম, ডাল ও তেল) সুবিধা ও মিশন সুবিধা (সাময়িক বন্ধ) আছে। সার্বক্ষণিক গার্ড (রানার নামে পরিচিত) সুবিধা আছে। জেলায় ও ব্যাটালিয়নে গাড়ি সুবিধা আছে। জেলা কমান্ড্যান্টের বাংলো সুবিধা আছে। তবে আনসার অনেকটা প্রচারবিমুখ বাহিনী।
প্রতিরক্ষা বিভাগে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা পুলিশ জনগণের কাছে অধিকতর পরিচিত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেও আনসার এখনো জনসাধারণের কাছে তেমন পরিচিতি পায়নি। নিজ জেলায় পদায়নের সুযোগ নেই।