গত দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো ২০২৩ সালে কর্মস্থলে নারী নির্বাহীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গবেষকেরা নারী নির্বাহীদের এই হ্রাসকে করপোরেট আমেরিকায় লিঙ্গসমতার ক্ষেত্রে একটি ‘আশঙ্কাজনক দিক’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
প্রতিষ্ঠানের আর্থিক তথ্য ও অ্যানালিটিকস নিয়ে কাজ করা মার্কিন প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল মার্কেট ইন্টেলিজেন্সের তথ্য বলছে, গত বছর নারী নির্বাহীরা প্রায় ৬০টি ‘সি-স্যুট’ (সিইও/সিওও)–এর পদ হারিয়েছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে এই হার ধীর হলেও তা বাড়ছে। মার্কিন কোম্পানিগুলোতে প্রধান নির্বাহী ও ফিন্যান্সিয়াল অফিসারসহ অন্যান্য শীর্ষ প্রায় ১৫ হাজার পদের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ১১ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। এর আগের বছরের ১২ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে বর্তমানে এই হার দাঁড়িয়েছে। ২০০৬ সালে এসঅ্যান্ডপি তথ্য নেওয়া শুরু করার করার পর নারী নির্বাহীদের এটাই প্রথম বড় হার হ্রাস পাওয়ার ঘটনা।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্যেষ্ঠ করপোরেট পদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ায় একসময় তা লিঙ্গসমতার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু উদ্বেগজনক হারে এই দিক পরিবর্তন হচ্ছে। ২০২২ সালে নারীদের সি-স্যুট প্রতিনিধিত্বে ‘আশ্চর্যজনক’ভাবে পরিবর্তনের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘এই বৃদ্ধি আর সূচকীয় বলে মনে হচ্ছে না। কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। পূর্ববর্তী লিঙ্গসমতার অনুমানও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণার জন্য পরিচিত পারডু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও একাডেমি অব ম্যানেজমেন্ট স্কলার এলেন কোসেক বলেছেন, ‘করপোরেট আমেরিকার উচ্চতর স্তরে নারীদের অগ্রগতির স্থবিরতা সংকটজনক। আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।’
তবে গবেষণা প্রতিবেদনে গবেষকেরা ঊর্ধ্বতন নির্বাহীদের পদে নারী প্রতিনিধিত্ব হ্রাসের সুস্পষ্ট কোনো তথ্য উল্লেখ করেননি। গত মাসে প্রকাশিত এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজস্ব উৎপাদনকারী ম্যানেজমেন্ট পদে নারীদের হার ৩০ শতাংশের কম। এই পদ সি-স্যুটে যাওয়ার একটি সোপান হতে পারে। সেখানেই নারীদের হার অনেক কম।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল উল্লেখ করেছে, জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের পদে নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধির হার ২০২৩ সালে ১০ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ।
মিডল জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ও একাডেমি অব ম্যানেজমেন্ট স্কলার সিমোন ফিপস এসঅ্যান্ডপির প্রতিবেদনের সঙ্গে জড়িত নন। তিনি বলেন, ‘নারীদের এন্ট্রি–লেভেল পদে নিয়োগ করা হয়, কিন্তু তাঁরা পুরুষদের মতো উন্নয়ন ও প্রচারের একই সুযোগ পান না।’
ফিপস বলেন, কোম্পানিগুলো প্রায়ই ‘একটি সহায়ক সংস্কৃতি লালন করতে ব্যর্থ হয়’, যা নারীদের কার্যকরভাবে তাঁদের দায়িত্বের বাইরে কাজগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে দেয়।
ফিপস আরও বলেন, যখন নারীরা সি-স্যুট পদে যান, তখন তাঁরা প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা বা চিফ ডাইভারসিটি অফিসারের মতো চিহ্নিত হতে থাকেন। প্রধান নির্বাহীর পদগুলোর মধ্যে চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) বা চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসারের (সিএফও) মতো চাকরির চেয়ে নারীরা প্রধান বিপণন কর্মকর্তার (সিএমও) পদে যাওয়ার সম্ভাবনাটা বেশি।
ওয়াশিংটন পোস্টে এক ই–মেইল মন্তব্যে ফিপস বলেছেন, ‘কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তি আছেন যাঁরা এমন কিছু ভূমিকা (নেতৃত্বের ভূমিকা) আছে, যা পুরুষদের জন্য বেশি উপযুক্ত এবং কিছু ভূমিকা (সমর্থন ভূমিকা) নারীদের জন্য উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করেন। লিঙ্গবিষয়ক এই গৎবাঁধা ধারণা বাদ দিতে হবে।’
শীর্ষস্থানীয় নারী নির্বাহীদের সংখ্যা হ্রাস করপোরেট আমেরিকা ও এর বাইরের বৈচিত্র্য, সমতা এবং অন্তর্ভুক্তি নীতির প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মিলে যায়। ২০২০ সালে ডিইআইয়ের (ডাইভারসিটি, ইকুইটি ও ইনক্লুশন) জনসমর্থন বেড়ে যাওয়ায় স্টরবাকস, নাইকি ও ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের মতো কোম্পানিগুলোতাদের নীতির আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
অধিকাংশ কোম্পানিতে চিফ ডাইভারসিটি অফিসারের পদে সাধারণত নারীরাই কাজ করেন। কিন্তু অনেক কোম্পানি এই কর্মকর্তাদের বাদ দিয়েছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ডিইআইয়ের জন্য নিয়োজিত অভ্যন্তরীণ টিম ও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ করা পরামর্শকদের ছাঁটাই করেছে।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল বলছে, মার্কিন কোম্পানিগুলোতে সি-স্যুট স্তরে লিঙ্গসমতা ২০৫৫ থেকে ২০৭২ সালের মধ্যে ঘটার সম্ভাবনা নেই। নারীদের হার কমার আগে গবেষকদের পূর্বাভাসের চেয়েও পাঁচ থেকে সাত বছর পর এটা ঘটতে পারে।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের তথ্য বলছে, ২০০৫ সালের হিসাবে নারীরা সি-স্যুট পদে মাত্র ৬ দশমিক ৫ শতাংশ জায়গা দখল করে আছেন।
ফরচুনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীরা সি–স্যুট পদে গেলেও তাঁদের চাকরির মেয়াদ পুরুষ নির্বাহীদের তুলনায় কম হয়। ২০২৩ সালের হিসাবে দেখা গেছে, ৫০০ কোম্পানির মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ নারী সিইও ছিলেন। কিন্তু তাঁদের মেয়াদ প্রায়ই তাঁদের পুরুষ সহযোগীদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম হয়। পুরুষেরা এই পদে গড়ে ৭ দশমিক ২ বছর থাকলেও নারীদের মেয়াদ হয় গড়ে সাড়ে চার বছর।