এআই কি জাপানের শ্রমিকসংকটের সমাধান দেবে

টোকিওর নারিতা কোকুসাই উচ্চবিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ইংরেজি কথোপকথনের দক্ষতা বাড়াতে এআইয়ের সঙ্গে অনুশীলন করছে
ছবি: সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে নেওয়া

জাপানে জনসংখ্যার হার কমে যাচ্ছে। এ কারণে দেশটিতে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অনেকেই ধারণা করছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দক্ষ শ্রমিকের এই ঘাটতি পূরণ করতে পারবে। ওশাকা ওশো ব্র্যান্ড জাপানের জনপ্রিয় ডাম্পলিং ও জিওজা (স্টিমড মোমো) তৈরি করে। কিন্তু প্যাকেটজাত করে যখন এসব বিক্রি করা হয়, তা যত বড় প্রতিষ্ঠানই হোক না কেন—কিছু প্যাকেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কিন্তু মহামারি চলাকালীন এই ডাম্পলিং ও জিওজার চাহিদা বেড়ে যায়। এ সময় এর মূল সংস্থা ইট অ্যান্ড হোল্ডিংসের কাছে প্রতিটি ডাম্পলিং পরীক্ষা করার জন্য বা চাহিদা বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত জনবল ছিল না। সে সময় প্রতিষ্ঠান বেশ সমস্যায় পড়ে যায়। এই সমস্যার সমাধানে গত বছরের জানুয়ারিতে এআই প্রযুক্তির আশ্রয় নেয় সংস্থাটি। কারখানায় এআই যেকোনো ত্রুটিপূর্ণ জিওজা শনাক্ত করতে পারে। বর্তমানে এই এআই প্রতি সেকেন্ডে দুটি ডাম্পলিং তৈরি করে। যা আগের কারখানার উৎপাদনের গতির চেয়ে দ্বিগুণ।

প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র কেইকো হান্ডা বলেছেন, ‘এআই চালুর মাধ্যমে আমরা উত্পাদন খাতে প্রায় ৩০ শতাংশ জনশক্তি কমিয়েছি।’

সংস্থাটি সম্প্রতি টোকিওর একটি রেস্তোরাঁয় আই-রোবো নামে একটি এআই-চালিত রান্নার রোবট চালু করেছে। শেফদের প্রশিক্ষণ দিতে সময় লাগে। এ কারণে কোম্পানি বলছে, এই প্রযুক্তি শ্রমের ঘাটতি সমস্যায় সাহায্য করবে। জাপানের শ্রম ঘাটতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে।

জাপানের বর্তমান জনসংখ্যা ১২ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার। গত ১৩ বছর ধরে দেশটির জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। দেশের শ্রমশক্তি ২০২২ থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত ১২ শতাংশ হ্রাস অব্যাহত থাকবে এবং এই সময়ের মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ শ্রমিকের অভাব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশ ইতিমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক জনসংখ্যার আবাসস্থল। এখানে ২৯ শতাংশ মানুষের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি।
দেশটিতে বিশ্বের জন্মহার সর্বনিম্ন। গত বছর মাত্র ৭ লাখ ৫৮ হাজার ৬৩১টি শিশুর জন্ম হয়েছে। ১৯ শতকে রেকর্ড শুরু হওয়ার পর থেকে জন্মহারের এটাই সবচেয়ে ছোট সংখ্যা।

দেশের জন্মহার বাড়ানোর জন্য সরকার নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দেশের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বলেছেন, প্রচেষ্টা কাজ করছে না।

বিশ্বের অনেক কোম্পানি এখন এআই প্রযুক্তি চালু করছে। এআইয়ের কারণে অনেকেই চাকরি হারাবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে জাপানে এখনো সব সেক্টরে এআই পৌঁছাতে পারেনি।

জাপানের বর্তমান জনসংখ্যা ১২ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার। গত ১৩ বছর ধরে দেশটির জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। দেশের শ্রমশক্তি ২০২২ থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত ১২ শতাংশ হ্রাস অব্যাহত থাকবে এবং এই সময়ের মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ শ্রমিকের অভাব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জাপানের অন্যতম প্রাচীন শিল্প কৃষিকাজ। জাপানে একজন কৃষকের গড় বয়স বর্তমানে ৬৮ দশমিক ৪ বছর। এই খাতে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন ধরনের রোগ, কীটপতঙ্গ ও আগাছা সনাক্ত এবং তা প্রতিরোধ করতে এখন এআই ব্যবহার করা হচ্ছে।

নিহোন নোহ্যাকু নামে একটি প্রতিষ্ঠান কৃষি রাসায়নিক তৈরি করে। এ কাজে প্রতিষ্ঠানটি নিচিনো এআই নামে একটি স্মার্টফোনের অ্যাপ তৈরি করেছে। এই অ্যাপটি কী ভুল হচ্ছে এবং কোন কীটনাশক প্রয়োজন হতে পারে, তা নির্ণয় করে দেয়।

নিহোন নোহ্যাকু নামে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা কেনতারু তানিগুচি বলেছেন, ‘নিচিনো এআইয়ের নির্ভুলতার হার প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। অ্যাপটি প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের মতো ভালো না হলেও একজন সাধারণ কৃষকদের চেয়ে ভালো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এই অ্যাপে যত বেশি সময় কাজ করি, ততই বুঝতে পারি, মানব বিশেষজ্ঞরা কতটা মেধাবী। তবে এমন বিশেষজ্ঞের সংখ্যা কমছে, তাই এআই সরঞ্জামগুলো এখন কাজে আসতে পারে।’

গত তিন বছর নিচিনো এআই অ্যাপটি ব্যবহার করছেন কৃষক কেনসুক তাকাহাশি। তিনিও একমত যে এআই এমন একটি সরঞ্জাম, যা কৃষি সেক্টরকে আধুনিকীকরণে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, ‘কৃষকের সংখ্যা দ্রুত গতিতে হ্রাস পাচ্ছে। তবে জাপানের মোট উৎপাদনের পরিমাণও বাড়ছে।’

তাকাহাশি স্বীকার করেছেন, বয়স্ক কৃষকরা এআইয়ের মতো নতুন প্রযুক্তি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতে পারেন। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁরাও দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘আপনি একবার কীটনাশক স্প্রে করার জন্য একটি ড্রোন ব্যবহার করার চেষ্টা করলে আর ম্যানুয়াল স্প্রেতে ফিরে যেতে পারবেন না।’

এদিকে জাপানে ইংরেজি ভাষাভাষীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সরকারের অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। এই ভাষা কার্যকরভাবে বলতে পারেন এমন শিক্ষকের অভাবের কারণে জাপান ইংরেজি দক্ষতার ক্ষেত্রে ক্রমাগত নিম্ন অবস্থানে আছে।

ইংরেজি শিক্ষকের এই ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ইকুমেনোপলিস নামে এআইচালিত একটি অনলাইন স্টার্ট-আপ টুল তৈরি করেছে। এতে ব্যবহারকারীরা প্রতি সেশনে ১৫ মিনিটের জন্য এআইয়ের সঙ্গে ইংরেজি কথোপকথন করতে পারেন। এই অ্যাপ ইতিমধ্যে দেশে ৫০টি স্কুলে চালু করা হয়েছে।

আপনি একবার কীটনাশক স্প্রে করার জন্য একটি ড্রোন ব্যবহার করার চেষ্টা করলে আর ম্যানুয়াল স্প্রেতে ফিরে যেতে পারবেন না।
কেনসুক তাকাহাশি, কৃষক

টোকিওর উপকণ্ঠে নারিতা কোকুসাই উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গত বছরের শেষে তিন মাস ইংরেজি অনুশীলন করার জন্য অ্যাপটি বাড়িতেও ব্যবহার করতে বলা হয়েছিল।

শিক্ষক শোকো তাকিগুচি বিবিসিকে বলেন, ‘এআই নিজে সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিটি শিক্ষার্থী কী ধরনের ইংরেজি কথোপকথন করতে পারে। এ কারণে তার প্রশ্নে তারতম্য হয়। প্রতিটি শিক্ষার্থীর সঙ্গে একের পর এক আলাদা কথোপকথন করা কঠিন। এআইয়ের কারণে এ ক্ষেত্রে সুবিধা হয়েছে।’ কথোপকথনের শেষে শিক্ষার্থীরা উচ্চারণ, ব্যাকরণ, সাবলীলতা এবং শব্দ ভান্ডারসহ ছয়টি ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া পান।

কো হানুয়ান নামের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার দুর্বলতা কী, তা এআইয়ের খুঁজে বের করা সহজ, তাই এই অ্যাপটি কার্যকর ছিল।’ অনলাইন টিউটোরিয়ালের জন্য এআই বেছে নেবেন কিনা—এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না। কারণ, এতে মানুষের স্পর্শের অভাব রয়েছে।

শোকো তাকিগুচি বলেছেন, কথা বলার দক্ষতা উন্নত করার জন্য এটি দরকারি। তবে এআইয়ের কথোপকথনগুলো অপ্রাকৃত মনে হয়। আর এআই ব্যবহারকারীর প্রতিক্রিয়া, শারীরিক অবস্থা বা স্বর পরিবর্তনের মূল্যায়ন করতে পারে না।

এআই মানব শিক্ষকদের প্রতিস্থাপন করবে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে ওই স্কুলের অধ্যক্ষ কাতসুতোশি ফুকুমিজু জোর দিয়ে বলেছেন, ‘এআই স্কুলে বা শিক্ষকদের ইংরেজি পাঠ প্রতিস্থাপন করতে পারে না এবং তা করা উচিত নয়।’

জাপান সরকার এআই নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। শ্রমিকসংকটের কারণে কানাগাওয়া অঞ্চলের ইয়োকোসুকা সিটির প্রশাসনিক কাজ যেমন প্রতিলিপি করা ও মিটিংয়ের সারসংক্ষেপে সহায়তা করার জন্য এআই চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা শুরু করেছে।

ওই শহরের মুখপাত্র কোহেই ওটা বলেছেন, ‘আমরা অসংখ্য নথি নিয়ে কাজ করি। সেই নথি তৈরি করতে অনেক সময় ও শ্রমের দরকার হয়। এ কাজের সহায়তা করার জন্য চ্যাটজিপিটিকে ধন্যবাদ। পরীক্ষামূলক এটা চালানোর পর হিসাব করে দেখেছি, আমরা বছরে ২২ হাজার ৭০০ ঘণ্টা কাজ বাঁচিয়েছি।’

জনপ্রশাসনে অদক্ষতা কাটিয়ে উঠতে ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত জাপান সরকারের জাতীয় ডিজিটাল এজেন্সি তার কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য এআই ব্যবহার শুরু করেছে।

এই এজেন্সির কর্মী মাসানোরি কুসুনোকি বলেন, ‘আমরা অনেক কিছু করতে চাই, কিন্তু আমাদের অল্প জনশক্তির কারণে তা করা হয় না। আমরা বেসরকারি খাতেও কীভাবে এআই ব্যবহার করতে পারি এবং তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারি, তা অন্বেষণ করার চেষ্টা করছে সরকার।’ তবে এআইয়ের উত্থান হলে শ্রমিকের আর খুব বেশি প্রয়োজন হবে না, তা মনে করেন না কুসুনোকি।

জাপানে যেকোনো পরিবর্তন ধীরে ধীরে ঘটে। এ কারণে অন্যদের তুলনায় কম অনিচ্ছার সঙ্গে এআই প্রয়োগ করছে দেশটি। কারণ, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বার্ধক্য ও জনসংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়া সমস্যার মোকাবিলার জন্য রোবট থেকে শুরু করে নারী, বয়স্ক এবং বিদেশি কর্মীসহ প্রতিটি সম্ভাব্য সমাধানের দিকে নজর দিয়েছে জাপান।

এআই কর্মশক্তির দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারলেও এটি এখনো মানব কর্মীদের প্রতিস্থাপনের জন্য বিশ্বের কোথাও প্রস্তুত হয়নি।