দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বদলে গেছে পৃথিবীর গতিবিধি। অতিমারির প্রকোপে স্কুল থেকে অফিস—অনেক কিছু্ই এখন ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ শব্দগুলো এখন যাপিত জীবনে নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে গেছে। বিশ্বের বহুজাতিক সংস্থাগুলো বাড়িতে বসেই কর্মীদের কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু এবার সে পরিস্থিতিতেই উল্টো পুরাণও দেখা গেল। প্রযুক্তিবিষয়ক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান গুগল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাঁরা স্থায়ীভাবে বাড়ি থেকেই কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁদের বেতন কিছু কাটা হবে।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, করোনার আগে অফিসে কাজ করতেন কর্মীরা। যদি তাঁরা স্থায়ীভাবে বাসায় বসে কাজ করার সুযোগ বেছে নেন, তাহলে তাঁদের বেতনে পার্থক্য ঘটবে। গুগলের এমন একটি ‘পে ক্যালকুলেটর’–এর স্ক্রিনশট পেয়েছে রয়টার্স। এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে সিলিকন ভ্যালি বা প্রযুক্তিজগতে বাসায় বসে কাজ করলে বেতন কাটার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে পরীক্ষামূলকভাবে। ফলে, এ প্রবণতার দিকে ঝুঁকছে অন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানও। কম ব্যয়বহুল এলাকায় সরে গেছেন—এমন ‘রিমোট’ কর্মীদের বেতনও কমিয়ে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও টুইটার। অন্যদিকে, অপেক্ষাকৃত ছোট কোম্পানি, যেমন রেডিট ও জিলো ‘লোকেশন-অ্যাগোনস্টিক পে-মডেলস’ অনুসরণ করছে। অ্যালফাবেট ইনকরপোরেশনের গুগল এরই মধ্যে কর্মীদের একটি ক্যালকুলেটর প্রস্তাব করেছে।
গুগলের এই পে ক্যালকুলেটর অনুযায়ী নির্ধারিত হবে কর্মীদের বেতন। ঠিক কীভাবে কাজ করবে এই ক্যালকুলেটর? কোন কর্মী কোথায় থাকেন, সেখানকার অর্থনীতি ইত্যাদি দেখে তাঁদের বেতন নির্ধারিত হবে। এর ফলে বাড়ি থেকে কাজ করা বহু কর্মীর বেতনই কমতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
গুগলের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘কর্মীদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে আমাদের “কমপেনসেশন প্যাকেজ” নির্ধারণ করা হয়। একজন কর্মী কোথা থেকে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন, এর ওপর ভিত্তি করে আমরা তাঁদের বেতন দিয়ে থাকি। আমাদের প্যাকেজ সব সময়ই স্থানের ওপর নির্ভরশীল এবং আমরা সব সময়ই স্থানীয় বাজারের হিসাবে সেরা বেতনই দিই।’ কিন্তু নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্থারই এক কর্মীর দাবি, গত জুনে আত্মপ্রকাশ করা ওই ক্যালকুলেটরের হিসাব অনুযায়ী, তাঁর বেতন অন্তত ১০ শতাংশ কমবে। তিনি জানাচ্ছেন, নতুন নিয়মে শহর থেকে শহর, এলাকা থেকে এলাকা হিসাবে বেতন নির্ধারিত হবে।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, বেতন কাটা হবে—এমন খবরে চাপের মুখে অনেক কর্মীই অফিস যাওয়া শুরু করেছেন। তবে স্বাভাবিকভাবেই বাধ্য হয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে তাঁদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যাচ্ছে না। এদিকে ফেসবুক কিংবা টুইটারের মতো সংস্থাও গুগলের পথেই হাঁটতে চলেছে বলে জানা গেছে। তারাও প্রত্যন্ত এলাকায় বাসস্থান পরিবর্তন করা কর্মীদের বেতন ছাঁটাই করতে পারে। পাশাপাশি রেডিট, জিলোও এ ধরনের এলাকাভিত্তিক মডেল কাজে লাগিয়ে কর্মীদের বেতন নির্ধারণ করতে চলেছে।
জুনে চালু করা কোম্পানির ‘ওয়ার্ক লোকেশন টুল’ অনুযায়ী এসব কর্মী যদি বাসায় বসে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে তাঁদের বেতন শতকরা প্রায় ১০ ভাগ কেটে নেওয়া হতে পারে। একজন কর্মী বাসায় বসে কাজের মাধ্যমকে বেছে নিয়েছিলেন। অফিসে যেতে তাঁর দুই ঘণ্টা সময় লাগে। তিনি বেতন কাটার কথা শুনে অফিসে বসে কাজ করতে চান। ওই কর্মী বলেন, ‘সম্প্রতি আমার পদোন্নতি হয়েছে। কিন্তু উচ্চ মাত্রায় এ বেতন কাটা হচ্ছে। আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি। তার জন্য পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি তো বেতন কাটার জন্য এ কঠোর পরিশ্রম করিনি।’
সেন্ট লুইসে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক জ্যাক রোজেনফেল্ড কর্মীদের বেতনের বিষয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেন, পরিবারসহ যাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, তা নিয়ে গুগলের বেতন কাঠামোতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এটা পরিষ্কার যে গুগলের এটা করা ঠিক হচ্ছে না। সংজ্ঞা অনুযায়ী, এসব কর্মীকে তাঁদের শ্রমের কারণে শতভাগ বেতন পরিশোধ করেছে গুগল। তাই এখন তারা কর্মীদের পূর্ণাঙ্গ বেতন দিতে সক্ষম নয়—এমনটা নয়।
গুগলের অভ্যন্তরীণ বেতনবিষয়ক ক্যালকুলেটরের স্ক্রিনশটে রয়টার্স দেখেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে এক ঘণ্টার ট্রেনযাত্রার পথ স্ট্যামফোর্ড, কানেটিকাটে বসবাসকারী একজন কর্মী যদি বাসায় বসে কাজ করেন, তাহলে তাঁকে শতকরা ১৫ ভাগ কম বেতন দেওয়া হবে। অন্যদিকে, নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাসকারী একজন সহকর্মী যদি বাসায় বসে কাজ করেন, তাহলে তাঁর কোনো বেতন কাটা হবে না। ওই স্ক্রিনশটে দেখা গেছে সিয়াটল, বোস্টন এবং সান ফ্রান্সিসকোর মধ্যে এ ব্যবধান শতকরা ৫ ভাগ থেকে ১০ ভাগ।