প্রতিবছরের ন্যায় এবার বিশ্বব্যাপী বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস পালিত যাচ্ছে। ফার্মাসিস্টদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ফার্মাসিউটিক্যাল আন্তর্জাতিক ফেডারেশন (এফআইপি) এবারের দিবসে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘পরিবর্তিত বিশ্ব স্বাস্থ্য’। বর্তমানে পুরো বিশ্ব কোভিড-১৯ মহামারিতে আক্রান্ত। গত কয়েক মাসে প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এই করোনা রোগে। বাংলাদেশেও পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং তিন লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত। স্বভাতই বিশ্ব স্বাস্থ্য আজ নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্যের পরিবর্তিত হুমকির সঙ্গে সমন্বয় রেখেই নিউ নরমাল জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। স্কুল, কলেজ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করাসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। মহামারির এই দুঃসময়ে দেশের চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্টরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে দেশের জনগণকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ফার্মাসিস্টরা ওষুধশিল্প চালু রেখে জনগণের দোরগোড়ায় ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছেন। তাই পরিবর্তিত স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নিরাপদ ওষুধ উৎপাদন, বিতরণ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণে ফার্মাসিস্টদের অবদান অনস্বীকার্য।
স্বাস্থ্যসেবার মূল বিষয় ‘রোগ-ওষুধতত্ত্ব’, অর্থাৎ রোগ হলে ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। এখন পর্যন্ত অধিকাংশ রোগেরই প্রতিকার হিসেবে আমরা কোনো না কোনো ওষুধ গ্রহণ করি। ওষুধ গ্রহণ করার প্রক্রিয়ায় এসেছে নানান পরিবর্তন। প্রাচীনকাল থেকেই চিকিৎসক রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে ওষুধ প্রদান করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আসছে। কিন্তু দিন দিন এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে জনসংখ্যার বৃদ্ধি, বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রনিক ডিজিজের প্রকোপ, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, জীবনধারার পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে মানুষের ওষুধ গ্রহণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার ফলে টাকমাথা, স্কিনের সতেজতা রক্ষাকারী, কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ গ্রহণের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিটি পেশায় পরিবর্তন এসেছে। ফলে বিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসক মূলত রোগ নির্ণয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে গেছেন। ওষুধ তৈরির দায়িত্ব চলে এসেছে ফার্মাসিস্টদের কাছে। কিন্তু উক্ত সময়ের পর বাজারে ওষুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় প্রতিটি রোগের আলাদা আলাদা ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে ফার্মাসিস্টরা শুধু ওষুধ তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছেন না। স্বাস্থ্যসেবায় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করার প্রয়াস শুরু হয়ে গেছে। ফলে এখন হেলথকেয়ারের পাশাপাশি ফার্মাসিউটিক্যাল কেয়ার নামক শব্দটি স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ ওষুধ শুধু তৈরি করে দিলেই হবে না, ওষুধের নিরাপদ, যৌক্তিক ও সঠিক উপায়ে গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
একটি পেশার উৎপত্তি হয় সমাজকে সেবা দেওয়ার জন্য। ফার্মেসি পেশার উদ্ভব হয়েছিল সে কারণে। এ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজের স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি ওষুধসেবার নিত্যনতুন পদ্ধতিকেও ফার্মেসি পেশাতে ধারণ করতে হচ্ছে। ফার্মেসি পেশায় তিন ধরনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনবল রয়েছে। প্রথমত, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বা পাঁচ বছর মেয়াদি ফার্মাসি সম্মান বিষয়ে পাসকৃত গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা। তাঁরা মূলত ওষুধের উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ এবং ওষুধের নিরাপদ ব্যবহারের ওপর দীর্ঘ পড়াশোনা শেষে একজন দক্ষ গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট হিসেবে সমাজে অবদান রাখতে পারেন। বর্তমানে উন্নত বিশ্বে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা মূলত হাসপাতালে বা কমিউনিটি ফার্মেসির দোকানে ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করেন। তাঁদের কাজের পরিধি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। দ্বিতীয়ত, এসএসসি পাস করে তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ফার্মাসি পড়াশোনা শেষে মূলত হাসপাতালগুলোতে ওষুধ বিতরণে কাজ করছেন ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টরা। তবে উন্নত বিশ্বে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের ফার্মেসি টেকনিশিয়ান হিসেবে অভিহিত করা হয়। তৃতীয়ত, এসএসসি পাস করে তিন মাসের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে ওষুধের দোকানে প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধ বিতরণের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন ফার্মেসি শিক্ষানবিশেরা।
উন্নত বিশ্বের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকের পাশাপাশি গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকা আবশ্যক। রোগীর দেহে যেকোনো ওষুধ প্রয়োগের একমাত্র অধিকার রাখেন ফার্মাসিস্ট। উন্নত বিশ্ব যেমন আমেরিকা, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, থাইল্যান্ড কিংবা নেপালে একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টকে এমবিবিএস চিকিৎসকের মতো পাঁচ বছর মেয়াদি সম্মান কোর্স এবং এক বছর ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসে ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে ছয় বছর পড়াশোনা করতে হয়। এই কোর্সের মূল লক্ষ্য হলো একজন ফার্মাসিস্টকে সেভেন স্টারে রূপান্তর করা। একজন হাসপাতাল গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট রোগীদের মোট সাত ধরনের সেবা প্রদান করেন। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ওষুধ গ্রহণের নিয়মাবলি, ক্ষেত্রবিশেষে ওষুধ প্রক্রিয়াকরণ, বিতরণ ইত্যাদি সেবার মাধ্যমে কেয়ারগিভার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়।
যৌক্তিক, উপকারী, নিরাপদ এবং কম খরচে ওষুধ, মেডিকেল ডিভাইস, বিভিন্ন উপকরণ কিংবা সেবা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টকে। স্থানীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে ফার্মাসিস্ট ওষুধনীতি কিংবা স্বাস্থ্য নীতিমালা তৈরিতে সহায়তা করে থাকেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যগুলোকে অর্জনে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ থেকে মূল্যায়নে ভূমিকা রাখতে পারে একজন ফার্মাসিস্ট। রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে সংযোগ ঘটানোর সর্বোত্তম মাধ্যম হলেন একজন ফার্মাসিস্ট। বিশেষ করে চিকিৎসক প্রদত্ত প্রেসক্রিপশন (চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র) অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণে রোগীকে সহায়তার মূল কাজটি একজন ফার্মাসিস্ট করে থাকেন। ফলে রোগী প্রেসক্রিপশন পাওয়ার পর থেকে ফার্মাসিস্টদের কাছে ওষুধবিষয়ক সমস্যার সঠিক নির্দেশনা পেতে পারেন। সুতরাং একজন ফার্মাসিস্টকে সাধারণ মানুষ ও চিকিৎসকের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার মতো সক্ষম হতে হবে।
গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টকে একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকের ভূমিকা পালন করতে হয়। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী জনবল, আর্থিকসহ আনুষঙ্গিক ভৌত উপকরণ এবং যন্ত্রপাতির সঠিক ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের মতো কাজটি ফার্মাসিস্টকে করতে হয়। নিত্যনতুন যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন, রোগের প্রকোপ পরিবর্তন, নতুন ওষুধ আবিষ্কারের তথ্য সংগ্রহ করে সে মোতাবেক রোগীর সঠিক ব্যবস্থাপনা চয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফার্মাসিস্টকে করতে হয়। ফার্মেসি পেশাসংশ্লিষ্ট সব জ্ঞান ফার্মাসিতে সম্মান কিংবা প্রফেশনাল ডিগ্রি অর্জন করলেই শেষ হয় না। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে জ্ঞান প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। আজকে একটি ওষুধ নিরাপদ মনে হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যেতে পারে। ফলে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা প্রসিদ্ধ জার্নাল বা ম্যাগাজিন কিংবা স্বাস্থ্য ও ওষুধবিষয়ক বার্তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হয়। একজন ফার্মাসিস্টকে সারা জীবন পড়াশোনার মধ্যে থাকতে হয়। নিত্যনতুন সৃষ্ট জ্ঞান অর্জনের ফলে একজন পরিপূর্ণ ফার্মাসিস্ট হতে পারে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ফার্মাসিস্টকে একজন গবেষক, উৎপাদক, প্রেসক্রিপশন দেওয়া, রোগী ও ওষুধের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করতে হচ্ছে। এসব জ্ঞান ফার্মাসিস্টকে তাঁদের পেশায় নিয়োজিত হওয়ার আগেই অর্জন করতে হবে। ফলে উন্নত বিশ্বে ফার্মাসি কারিকুলামেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ১৯৯৯ সালে ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসি ফ্যাকাল্টি গবেষণাভিত্তিক ফার্মাসি–শিক্ষা থেকে ফার্মাসিউটিক্যাল কেয়ারভিত্তিক কোর্স কারিকুলামের প্রস্তাব করেছিল। ফলে ফার্মাসি শিক্ষার প্রসার চার বছর মেয়াদি থেকে ছয় বছর মেয়াদি ফার্ম ডি ডিগ্রিতে রূপান্তর করা হয়। আমেরিকাতে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব কলেজ অব ফার্মাসি, অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল অব ফার্মাসি এডুকেশন এবং আমেরিকান ফার্মাসিস্ট অ্যাসোসিয়েশন মিলে ডক্টর অব ফার্মাসি কোর্স (ফার্ম ডি) অনুমোদন দেয়; যা ২০০০ সালে শুরু হয়। এরপর থেকেই রোগীকেন্দ্রিক ওষুধ ব্যবস্থাপনা ফার্মাসি কোর্সের মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়। শুধু তা–ই নয়, অ্যাডভান্স ফার্মাসি প্র্যাকটিস এক্সপেরিয়েন্স নামক ৩৬ সপ্তাহের একটি ট্রেনিং শেষ করে তবেই রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট হতে পারেন, যাঁরা বিভিন্ন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসকের পাশাপাশি রোগীকে সেবা দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন কমিউনিটি ফার্মেসি দোকানেও তাঁরা ওষুধ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত থাকেন।
ইতিমধ্যে দেশের ৪০টির অধিক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় প্রতিবছর এক হাজারের বেশি মানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট পাস করে দেশের ওষুধশিল্পে কাজ করছেন। তবে বৃহৎসংখ্যক গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের নিরাপদ ওষুধের ব্যবহারবিষয়ক অর্জিত জ্ঞান হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাতে দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে হাসপাতালে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট কাজ করছেন, অথচ দেশেই দক্ষতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা অনেকেই বেকার বসে আছেন। তাই অবিলম্বে হাসপাতালগুলোতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল ফার্মেসি ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে।
হাসপাতালগুলোতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর ‘সরকারি হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ প্রদান’–সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। প্রজ্ঞাপনে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নবম গ্রেডে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিরেক্টরেট অব ফার্মাসিউটিক্যাল সার্ভিস নামে একটি অধিদপ্তর গঠনেরও প্রস্তাব ছিল। এ ছাড়া একই পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি আরেকটি প্রজ্ঞাপনে হাসপাতালে ফার্মাসিউটিক্যাল সার্ভিস চালু করার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় লোকবল সংগ্রহের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এ–সংক্রান্ত নিয়োগ কার্যক্রম এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়