২০১৭ সালে অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় পরীক্ষাটি বাতিল করা হয়। পরবর্তী সময়ে পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। তাতেও গলদ থেকে যায়। দ্বিতীয়বার অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কয়েকটি সেট কোডে বিভক্ত ছিল। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সেট কোডের প্রশ্নে সমস্যা দেখা দেয়। একই সেট কোডের প্রশ্ন হওয়া সত্ত্বেও প্রশ্নপত্র শুরু হয় দুটি ভিন্ন সাবজেক্টের (গণিত ও ইংরেজি) প্রশ্ন দিয়ে। একই সেট কোডে দুটি ভিন্ন বিষয় দিয়ে প্রশ্নপত্র শুরু পরীক্ষার্থীরা সম্ভবত তখনই প্রথম দেখলেন। ফলে পরীক্ষার্থীদের মনে একধরনের সংশয় তৈরি হলো, যার নেতিবাচক প্রভাব পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়নে প্রতিফলিত হয়। উক্ত সেটের গণিত দিয়ে শুরু প্রশ্নে সবাই অকৃতকার্য হয়েছিলেন।
বিষয়টি কারও দৃষ্টিগোচরে আসার কথা নয়। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের অনেকেই বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই ফলাফল পুনর্বিবেচনার জন্য অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করেন। আবেদনটি কর্তৃপক্ষ বিশেষ বিবেচনায় এনে ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন করে। এর ফলে অনুত্তীর্ণদের মধ্য থেকে অনেকেই উত্তীর্ণ বা কৃতকার্য হয়।
প্রথমবার প্রশ্নপত্র ফাঁস, দ্বিতীয়বার ভালো পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়নে ত্রুটির কারণে একটি নির্দিষ্ট সেটের প্রশ্নধারী (একই সেট কিন্তু গণিত বিষয় দিয়ে প্রশ্ন শুরু) পরীক্ষার্থী সবাই অকৃতকার্য থেকে যায়। বাদ পড়া পরীক্ষার্থীদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি না হলে পরবর্তী লিখিত পরীক্ষায় তাঁরা অংশগ্রহণ করতে পারতেন না।
যদিও পরবর্তী সময়ে তাঁদের মধ্য থেকে অনেকেই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়ে চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছেন। এখন তাঁরা ব্যাংকে চাকরি করছেন। প্রথমবার প্রশ্নপত্র ফাঁস, দ্বিতীয়বার ফলাফল মূল্যায়নে ত্রুটির কারণে মেধাবীরা চাকরি থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। এসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একটি ভুলের কারণেই সাধারণ পরীক্ষার্থীদের পাশাপাশি মেধাবীরাও ট্র্যাক থেকে ছিটকে পড়েন। প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা উত্তরপত্র মূল্যায়নে অসামঞ্জস্যতা সবই চাকরিপ্রত্যাশীদের মনোবল নষ্ট করে দেয়।
এভাবে চলতে থাকলে চাকরিপ্রত্যাশীরা কোন জায়গায় আস্থা খুঁজে পাবেন?
এমনিতে বেকারদের পক্ষে পরিবারের কাছে টাকা চাওয়া কষ্টের ব্যাপার। পরীক্ষার জন্য ঢাকায় যাওয়া-আসা বাবদ যে টাকার প্রয়োজন, তা অনেকেই ধারদেনা করে জোগান দিয়ে থাকেন। এমনও অনেক পরিবার আছে, যারা বেকার ছেলে বা মেয়েটির দিকে চাকরি পাবার আশায় তাকিয়ে থাকে। এত কষ্টের পরও প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা অন্য কোনো ভুলের কারণে পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলে চাকরিপ্রত্যাশীরা যাবেন কোথায়? শুধু একটি পরীক্ষার আশায় প্রায় শুক্রবারই চাকরিপ্রত্যাশীরা দেশের নানা প্রান্ত থেকে ঢাকায় ছুটে আসেন। গত ৬ নভেম্বর পাঁচ ব্যাংকের অফিসার (ক্যাশ) পদে সমন্বিত পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন অনেক প্রার্থী। সেদিন ছিল পরিবহন ধর্মঘট। অনেক কষ্ট করে ঢাকায় এসে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার পর তাঁরা যখন শুনতে পেলেন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, তখন তাঁদের দুঃখের সীমা ছিল না। যদিও পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে।
তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে চাকরি পরীক্ষার একটা অনৈতিক উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। কোনো কিছুর বিনিময়ে চাকরি একবার পেয়ে গেলে ভবিষ্যতের পথ সুগম হয়। চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তার বিনিময়ের মাধ্যম ‘অর্থ’ হলে অর্থকে তুচ্ছ বিবেচনায় নিয়ে চাকরির জন্য পাকা স্থান করা চাই। তাই সেখানে ব্যাপারীর অভাব থাকে না। ঘটে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো অনৈতিক সব ঘটনা, যার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে।
আমাদের সময়ে আমরা কখনো প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা শুনিনি। তবে যেটুকু শুনতে পেতাম, তা হলো পরীক্ষার হলে নকল করা। পরীক্ষার হলে প্রবেশের সময় কেউ কেউ টুকলি নিয়ে আসত। তা ছাড়া আর তেমন কিছু নয়। এখন নকলের পরিবেশ আর নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে তা থেকে পরিত্রাণ পেতে কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা বাতিল করে নতুনভাবে পরীক্ষার আয়োজন করে। তবে তা হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সাময়িক উপায়। সব মিলিয়ে বেকারদের দুর্দশা লাঘবের কোনো পথ নেই। যেখানে বেকারদের একবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করাই কষ্টকর, সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা ভুল পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য পুনরায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ মানসিক পীড়া এবং অর্থনৈতিক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চাকরি পরীক্ষার জন্য রাজধানী ঢাকায় বারবার যাতায়াত কতজন বেকারের সাধ্য থাকে। সেটা আমরা কখনো বিবেচনায় নিই না।
তাই চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে সব পরীক্ষার্থীর ওপর দুর্দশা নেমে আসে। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে যে কয়জন প্রশ্ন পান, শুধু তাঁরাই অনৈতিকভাবে সুফল ভোগ করার চেষ্টা করেন। তার প্রভাব অন্যজনকে তেমন বিচলিত করে না। যদিও তা কখনো কাম্য নয়। চাকরির মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য সবাইকে চরম মূল্য দিতে হয়। ফলে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত থেকে যান। একজনের অনৈতিকতার দায় অন্যজনের সারা জীবনের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা যে জায়গায়ই চষে বেড়াবেন, দুর্নীতি তাঁদের পিছু ধাওয়া করবে। কারণ, তাঁদের চাকরিজীবনের শুরুই হয় দুর্নীতির মধ্য দিয়ে।
বর্তমানে বাংলাদেশের বেকাররা সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছেন। একদিকে করোনা কালের সময়ের বেকারত্ব, অন্যদিকে একই দিনে একসঙ্গে অনেকটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া। তার ওপর প্রশ্নপত্র ফাঁস চাকরিপ্রত্যাশীদের উদ্বেগের আরেক কারণ।
বেকারত্বের কারণে তাঁদের না আছে চলার সামর্থ্য, না থাকে কোনো কিছুতে ভালো করার প্রত্যাশা। আছে শুধু না বলার ভাষা। এভাবেই তাঁদের কষ্টের দিনগুলো বহমান।
টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন সংগ্রহ করে কৃতকার্য হয়ে যাঁরা চাকরি প্রত্যাশা করেন, তাঁরা চাকরির ক্ষেত্রটাকে অশোভন করে তোলেন। তাঁদের যেভাবেই হোক খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা উচিত। ইতিমধ্যে তাঁদের অনেকেই ধরা পড়েছেন। আশা করি মূল হোতা বেরিয়ে আসবে। এদের বিচার হবে, মেধাবীরা নিজেদের যোগ্যতায় চাকরি পাবেন, সেটাই হবে আমাদের পরম চাওয়া।
*লেখক: ব্যাংকার, কলামিস্ট। anjan999roy@gmail.com