করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মৃতের সংখ্যায় আমেরিকা শীর্ষে। এই করোনা মহামারিতে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় মানুষদের ছুটতে হচ্ছে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে। তবে করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসক ও নার্সরা চাকরি ছেড়ে পেশা বদলাতে চাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার দ্রুত অবসর নিচ্ছেন। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চিকিৎসকদের চেম্বার। আর এর কারণ হলো করোনা মহামারি মোকাবিলায় মানসিক ও শারীরিক চাপ সইতে পারছেন না তাঁরা।
চিকিৎসক কেলি ম্যাকগ্রেগোরি মহামারির কারণে মিনেসোটার মিনিয়াপলিস শহরে থেকে একটু দূরে তাঁর ব্যক্তিগত শিশু চিকিৎসাকেন্দ্রটি বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটা অনেক কঠিন ছিল। এটা (চিকিৎসাকেন্দ্র) আমার বাচ্চার মতো ছিল।’ দুই বছর আগে কেলি ম্যাকগ্রেগোরি এই পেডিয়াট্রিক কেন্দ্রটি চালু করেছিলেন। এখানে তিনি রোগীদের সঙ্গে ইচ্ছামতো সময় কাটাতেন। শিশুদের মা–বাবাদের নানা প্রশ্নের উত্তরও দিতেন তিনি।
করোনাভাইরাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে কেলি ম্যাকগ্রেগোরি তাঁর চিকিৎসাকেন্দ্রটি বন্ধ করে দেন। কারণ, মহামারির মানসিক চাপ আর তিনি নিতে পারছিলেন না। কেলির স্বামী নতুন চাকরি পাওয়ায় আগস্টে তাঁর শিশু চিকিৎসাকেন্দ্রটি বন্ধ করার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান ফিজিশিয়ান ফাউন্ডেশন মার্কিন সাড়ে তিন হাজার চিকিৎসকের ওপর এক জরিপ চালিয়েছে। জরিপে তারা দেখেছে, ৮ শতাংশ চিকিৎসক সম্প্রতি তাঁদের চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন। চেম্বার বন্ধ হওয়ায় ১৬ হাজার চিকিৎসক কাজ হারিয়েছেন। জরিপে অংশ নেওয়া চিকিৎসকদের মধ্যে ৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা আগামী বছরের মধ্যে তাঁদের প্র্যাকটিস বন্ধ করে দেবেন। অনেক চিকিৎসক ও নার্স তাঁদের নিজেদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন। মহামারি তাঁদের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
অনেক চিকিৎসক ও নার্স মহামারিতে কাজ করতে করতে এরই মধ্যে ক্লান্ত। তাঁরা এখন বিরতিতে যেতে চাইছেন। কেউ বলছেন, নতুন করে কাজ করার মতো শক্তি তাঁদের নেই। ল্যারি এ. গ্রিন সেন্টারের চালানো আরেকটি বিশ্লেষণে একই রকম ফল পাওয়া গেছে। গত সেপ্টেম্বরে প্রাইমারি কেয়ার ক্লিনিকগুলোতে চালানো জরিপে এক-পঞ্চমাংশ ক্লিনিক জানিয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠানে প্র্যাকটিস করা কোনো না কোনো চিকিৎসক অবসর নিয়েছেন অথবা সময়ের আগেই অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর যাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁরা একনাগাড়ে সেবা দিয়ে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন।
অবেদনবিদ হিসেবে একটি হাসপাতালে কাজ করছেন ৬৫ বছর বয়সী চিকিৎসক জোয়ান বেনকা। তিনিও আর কাজ করতে চান না। রাত–দিনের কাজ থেকে অবসর নিতে চান। তিনি বলেন, ‘সত্যিই, বলছি যদি মহামারি না হতো, তাহলে আমি এখনো কাজ করে যেতাম। এই মুহূর্তে অবসর নেওয়ার পরিকল্পনা আমার ছিল না।’ তাঁদের একটি ডে কেয়ার সেন্টার আছে।
জোয়ান বেনকার মেয়ে ও মেয়েজামাই একটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। সবচেয়ে অসুস্থ কোভিড রোগীদের চিকিত্সা হয় আইসিইউতে। সেখানে তাঁদেরও থাকতে হয়। তাঁদের ছোট দুটি বাচ্চা আছে। বাচ্চার জন্য তাঁরা চিন্তিত। যুক্তরাষ্ট্রে বসন্তে যখন কোভিড রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়তে লাগল, তখনই তাঁদের ডে কেয়ার সেন্টারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। মেয়ের সন্তানদের দেখভালের জন্য আর করোনার ভয়ে জোয়ান বেনকা কাজ থেকে সরে দাঁড়ান।
রকভিলের একটি হাসপাতালের অবেদনবিদ মাইকেল পেক। ৬৬ বছর বয়সী মাইকেল পেক গত এপ্রিল থেকে হাসপাতালের আইসিইউতে কাজ করছেন। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের নিয়েই তাঁর কাজ। মহামারির সময়ে কাজ করতে গিয়ে নিজের স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তিনি। দিন শেষে তাঁর মনে হতো ‘আমি তো শেষ’। তিনি বলেন, ‘আমি আমার জীবন এগিয়ে নিতে চাই। আমি অসুস্থ হতে চাই না।’ আর তাই তিনি কাজের কর্মঘণ্টা কমিয়ে ফেলেছেন।
আমেরিকা মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সুশান আর বেইলি বলেন, করোনার কারণে চিকিৎসকেরা এমনিতেই নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, করোনার শুরুতে ভালো হাসপাতালগুলোতে মাস্ক ও পিপিই সরবরাহ করা হতো। তবে সব হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এই পিপিইর সুবিধা শুরুর দিকে পাননি। কারণ, এর সঙ্গে আর্থিক সংগতি যুক্ত ছিল।
১৪ বছর ধরে নার্স পেশায় জড়িত ব্যারি। মহামারির এ সময়ের মতো বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়নি। এ সময়ে কাজের চাপে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আর সইতে না পেরে তিনি ডিসেম্বর থেকে কাজ ছেড়ে দেওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস